বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য হুমকিতে
- আপলোড সময় : ০৮-১০-২০২৪ ০২:০৪:৩৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-১০-২০২৪ ০২:০৪:৩৬ অপরাহ্ন
শতাধিক কোম্পানি বালাইনাশক আমদানি ও উৎপাদনের অনুমোদনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন।
গত বছর দেশে ৩৯ হাজার টনের বেশি বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছে। বর্তমানে এর বাজার এখন সাত হাজার কোটি টাকার মতো।
দেশের কৃষিতে বালাইনাশকের ব্যাপক ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করছে। বর্তমানে কৃষিতে বিষের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে আরো শতাধিক কোম্পানি বালাইনাশক আমদানি ও উৎপাদনের অনুমোদনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন। বিগত সাত দশক ধরে ফসলের সুরক্ষায় ব্যবহার হচ্ছে বালাইনাশক বা কীটনাশক। গত বছর দেশে ৩৯ হাজার টনের বেশি বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছে। বর্তমানে এর বাজার এখন সাত হাজার কোটি টাকার মতো। কৃষি বিভাগ এবং কৃষি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শস্যক্ষেতে প্রায় ৬০৭টি বিভিন্ন জাতের পোকা রয়েছে। এর মধ্যে ২৩২টি বা ৩৮ শতাংশ পোকা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। আর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ফসলের উপকার করছে বাকি সব কীটপতঙ্গ। ১৮৩টি পোকার জাত বা ৩০.১৫ শতাংশ পোকা সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী। আর ১৯২টি বা ৩১.৬৩ শতাংশ পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে বা পরজীবি ও পরভোজী হিসেবে ফসলের উপকার করে থাকে। কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারে ওসব উপকারী পোকা-মাকড়ও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কীটনাশকের কারণে পরাগায়ণের জন্য সবচেয়ে উপকারী মৌমাছি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাছাড়া বর্তমানে বালাইনাশকের ব্যবহার মানবস্বাস্থ্যেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে। কীটনাশকের মারাত্মক ক্ষতিকারক সূক্ষ্ম উপাদানগুলো দেহে প্রবেশ করে মারণঘাতি ব্যাধি সৃষ্টি করছে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদভাবে কীটনাশক প্রয়োগের মাধমে কৃষকরা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগের কারণও হচ্ছে। আবার এ ধরনের কীটনাশক সরাসরি পান করে আত্মহত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়তই কীটনাশক পান করা রোগী ভর্তি হচ্ছে। পাশাপাশি কীটনাশক দূষিত করছে মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানি।
সূত্র জানায়, ফসলের রোগ-বালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের জন্য মূলত পাঁচ ধরনের বালাইনাশক দেশে আমদানি ও ব্যবহার হয়। আর তা হচ্ছে- কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, পতঙ্গনাশক ও রোডেন্টিসাইড (ইঁদুর মারা বিষ)। ২০০০ সালেও দেশে বালাইনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল আটটি। ২০২৩ সালে তা ২৩টিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০০ সালে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল ২০০টি, বর্তমানে তা ৭০০টিতে উন্নীত হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বালাইনাশকের ব্যবহার মাত্র চার হাজার টন। দেশে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বালাইনাশকের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে। ওই দুই বছরে যথাক্রমে ৪৯ হাজার ও ৪৫ হাজার টন বালাইনাশকের ব্যবহার হয়েছে। আর ২০১০ সালে ৪২ হাজার ২৪০ টন, ২০১১ সালে ৪৪ হাজার ৪২৩ টন, ২০১২ সালে প্রায় ৪১ হাজার টন ব্যবহার হয়েছে। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত বালাইনাশকের ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এর ব্যবহার ৩৭ থেকে ৩৮ হাজার টনের মধ্যেই ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে সব ধরনের বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ১৫৭ টনে; যা ২০২২ সালে ছিল ৩৯ হাজার ২৮৩ টন এবং ২০২১ সালে ছিল ৩৯ হাজার ৫৪৩ টন। সব মিলিয়ে গত চার দশকের বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ টন বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, দেশে তরল ও গুঁড়া বালাইনাশকের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গত বছর আটটি বহুজাতিক কম্পানি প্রায় দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বালাইনাশক আমদানি করেছে।
একই সময় স্থানীয় ৬৯৩টি আমদানিকারক কম্পানি এই পণ্য আমদানি করেছে দুই হাজার ১৫০ কোটি টাকার। বালাইনাশক আমদানির পর সেগুলো ফরমুলেশন, বিপণন এবং মূল্য সংযোজন করা হচ্ছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমদানি, উৎপাদন, ডিলার, পাইকারি, খুচরা ব্যবসাসহ সব ধরনের ব্যবসা মিলে বালাইনাশক বাজার এখন প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার। এদিকে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) ও গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (জিএপি) নীতিমালার পরামর্শ হলো-কীটনাশক ব্যবহারের সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার ও শরীরের অন্য অংশে কীটনাশকের অনুপ্রবেশ রোধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাতাসের উল্টো দিকে তা প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু এসব পরামর্শ মানার ক্ষেত্রে কৃষকদের সচেতন করা হয়নি। এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, সুরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন ৯৩ শতাংশ কৃষক। আবার রাজধানীর সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কৃষক। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের (বিওএএন) সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নাজিম উদ্দিন জানান, বালাইনাশকের প্রাতিষ্ঠানিক বাজারের সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার যুক্ত করলে বাজার আরো বড় হবে। এছাড়া অবৈধভাবে বালাইনাশক আমদানি এবং উৎপাদন হচ্ছে। বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিকর পোকা দমনে বালাইনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে উপকারী পোকা ধ্বংস করা হচ্ছে। নদী-নালা কিংবা জলাধারে এখন সেভাবে ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ