ঘোষণা দিয়েও বিনিয়োগকারীদের সবশেষ দুই বছরের লভ্যাংশ বুঝিয়ে না দেওয়ার কৈফিয়ত জানতে ১৪ কোম্পানির চেয়ারম্যান ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের ডেকেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। বৈঠকে আগের দুই বছরের লভ্যাংশ কত দ্রুত বিতরণ করতে পারবে সেটিও জানতে চাওয়া হবে সম্প্রতি জেড ক্যাটাগরিতে নেমে যাওয়া ২৭ কোম্পানির মধ্যে এই ১৪ কোম্পানির শীর্ষ কর্তাদের কাছ থেকে। গতকাল রোববার বেলা ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিএসইসি ভবনে কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবকে ডাকা হয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘‘ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারিদের পাওনা। কোম্পানি যেহেতু ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে, তা বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই বুঝিয়ে দিতে হবে। এটা না হওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কমিশন বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে সর্বদা তৎপর। কোম্পানিগুলো কতদিনের মধ্যে ঘোষিত ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের বুঝিয়ে দিবে তা জানতে চাইবে কমিশন।’ কমিশন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং পুঁজিবাজারের সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে বলে যোগ করেন তিনি। সভায় ডাকা কোম্পানিগুলো হল- লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড, এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি, ভিএফএস থ্রেড ডাইং লিমিটেড, ফরচুন সুজ লিমিটেড, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেড, দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বিচ হ্যাচারি লিমিটেড, অ্যাডভেন্ট ফার্মা লিমিটেড, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, লিবরা ইনফিউশন লিমিটেড, প্যাসিফিক ডেনিমস লিমিটেড ও ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। এসব কোম্পানির কয়েকটি গত ২০২৩ সালের হিসাব বছরের সঙ্গে আগের হিসাব বছরের ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ করেনি। অনেকে কিছু অংশ বিতরণ করেছে। বেশির ভাগই লভ্যাংশ ঘোষণার পরপরই তারল্য সংকটে পড়েছে বলে দাবি করেছে। লভ্যাংশ না দেওয়া, বার্ষিক সাধারণ সভা না করা এবং ছয় মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২৭ কোম্পানিকে ‘বি’ শ্রেণি থেকে ‘জেড’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), যা পরের কার্যদিবস থেকেই কার্যকর হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশে জেড শ্রেণিতে পাঠানো ওই তালিকায় ১৪টি কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করেও বিনিয়োগকারীদের বুঝিয়ে দেয়নি।
দুই বছর বকেয়া লুব রেফের
২০২২ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের মাত্র ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের লুব-রেফ(বাংলাদেশ)। আগের বছর ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেও তা এখনও বিতরণ করেনি। কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করেও গত দুই বছর ধরে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ বুঝে পাননি। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বকেয়ার পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং আগের বছরে বকেয়া ছিল ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির রিজার্ভ রয়েছে ২৬৭ কোটি টাকা। সবশেষ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবেদন তৈরির সময়েও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৬৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। মোট বকেয়া লভ্যাংশের পরিমাণ ২২ কোটি টাকা জানিয়ে লুবরেফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘‘কোম্পানির উদ্যোক্তারা লভ্যাংশ নেননি। এতে মোট বিতরণের জন্য লভ্যাংশ দাঁড়ায় ২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমরা ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের পরিশোধ করতে পেরেছি। বাকি ১০ কোটি টাকা দিতে পারিনি ব্যবসা মন্দা হওয়ার জন্য।’’ কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিক গণ প্রস্তাব (আইপিও) এর মাধ্যমে উত্তোলিত ১৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা খরচ করে সক্ষমতা বাড়াতে বিএমআরই করার কথা। আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএমআরইতে গত ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকা ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেছে কোম্পানিটি। মোহাম্মাদ ইউসুফের ভাষ্য, বিএমআরআরই খাতে বাকি অর্থ বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকে রেখে আরও ঋণ নেওয়ার জন্য সমঝোতায় পৌঁছেছিল। ঋণের সেই অর্থ দিয়ে চলতি মূলধন যোগান দেওয়ার কথা কোম্পানি পরিচালনায়। কিন্তু ব্যাংক ঋণ না দেওয়ায় চলতি মূলধন সংকটে পড়ে যায় কোম্পানিটি। বর্তমানে অর্থ সংকটে পড়া ব্যাংকটি টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। কোম্পানিকে এলসি খুলতেও সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার মত সক্ষমতা কোম্পানিটির রয়েছে। এরপরও লভ্যাংশ দিতে না পারার বিষয়ে লুব-রেফের নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান আর্টিসান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস এর স্বত্বাধিকারী এএফএম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা অ্যাকাউন্স দেখেছি। ব্যাংকে তো তাদের টাকা ছিল। লভ্যাংশ কেনো দিতে পারেনি তার ব্যাখ্যা কোম্পানি দিতে পারবে।’’ লভ্যাংশ না দেওয়ার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও সদ্য যোগ দেওয়া লুব-রেফের কোম্পানি সচিব কবির আহমেদ বলেন, ‘‘আমি সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। সব তথ্য আমার কাছে নেই। কমিশনের বৈঠকে কোম্পানির পক্ষে চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাখ্যা দিতে পারেন।’’ অন্যদিকে সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ বলেন, ‘‘ব্যাংক ঋণ দেয় কোম্পানির ব্যবসা, লেনদেন আচরণ দেখে। এসব বিবেচনায় উত্তীর্ণ হলেও তো সমস্যা নেই। পুরনো গ্রাহক হিসেবে তার সঙ্গে আমাদের কিছু লেনদেন এখনো আছে। সেসব বিবেচনায় নিয়েই তো ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিবে।’’ দুই বছরে আগে ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৫২ টাকা ৩০ পয়সা। সেখান থেকে দর কমতে কমতে গত ২৫ সেপ্টম্বর পর্যন্ত ছিল ১৭ টাকা। জেড শ্রেণিতে পাঠানোর পরে শেয়ার দর আরও কমে হাতবদল হয় ১৪ টাকা ৪০ পয়সায়। জেড শ্রেণিতে যাওয়ার পরে ছয় কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর হারায় দুই টাকা ৬০ পয়সা বা ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।
নগদ টাকার সংকটে ফরচুন স্যুজ
শতভাগ রপ্তানিমুখী জুতা তৈরিকারক কোম্পানি ফরচুন স্যুজ ২০২৩ সালে মুনাফা করেছিল ১৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে নগদ ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। আগের বছর ২০২২ সালে ৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা মুনাফা করার বিপরীতে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরমধ্যে ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস ছিল। আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৩ সালের জন্য কোম্পানিটির বকেয়া লভ্যাংশের পরিমাণ হচ্ছে ছয় কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগের বছরের বকেয়া লভ্যাংশের পরিমাণ হচ্ছে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ফরচুনের নিরীক্ষা করে আর্টিসান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যন্ট। নিরীক্ষার তথ্য বলছে, কোম্পানিটির রিজার্ভ রয়েছে ৭৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ঘোষণা দিয়েও লভ্যাংশ বিতরণ না করার বিষয়ে ফরচুনের কোম্পানি সচিব রিয়াজ উদ্দীন ভূঁইয়া আর্থিক সংকটের দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আমদানি-রপ্তানির কাজ হয় ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। কিন্তু রপ্তানি করা ডলার থাকা স্বত্বেও ইসলামি ব্যাংক আমাদের কোম্পানির এলসি খুলে দেয়নি। ব্যাংক ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও তারল্য সংকটের কথা বলে মূলধন যোগান দেয়নি। এতে আমরাও সংকটে পড়ে যাই।’’ কোম্পানি লাভ করার পরও লভ্যাংশ বিতরণ করতে না পারার আর কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। জেড শ্রেণিতে পাঠানোর আগে ২৩ টাকা ৯০ পয়সা দরে হাতবদল হওয়া শেয়ারটি সবশেষ ১৮ টাকায় লেনদেন হয়। ছয় কার্যদিবসে শেয়ার দর হারিয়েছে ৫ টাকা ৯০ পয়সা বা ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
ছাগল কাণ্ডের মতিউরের ভর এসকে ট্রিমসে
তৈরি পোশাক খাতের এক্সেসরিজ উৎপাদনকারী রপ্তানিমুখী কোম্পানি এস কে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড। সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আলোচিত সময়ে সাত কোটি ৯৭ লাখ টাকা নিট মুনাফা করে। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দুই কোটি ৩৩ লাখ টাকার লভ্যাংশ বকেয়া ছিল কোম্পানিটির। কোম্পানি সচিব রিয়াজ হায়দার বলেন, ‘‘আমাদের মাত্র আনুমানিক ৬০ লাখ টাকার মত লভ্যাংশ বিতরণ বকেয়া আছে। বর্তমানে ব্যাংক হিসাব স্থগিত আছে। আদালতের মাধ্যমে তা সচল করার চেষ্টা চলছে। ব্যাংক হিসাব সচল হলে লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হবে।’’
গত কোরবানির ঈদে ছাগল কাণ্ডে আলোচনায় আসেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান। এ কোম্পানিতে মতিউর রহমানের বিনিয়োগ আছে এমন অভিযোগে এস কে ট্রিমসের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোম্পানিটিরও নিরীক্ষক ছিল আর্টিসান চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কৈফিয়ত শুনতে ডেকেছে বিএসইসি
লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ ১৪ কোম্পানি
- আপলোড সময় : ০৭-১০-২০২৪ ১২:২২:২৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-১০-২০২৪ ১২:২২:২৮ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ