মৃত ভাষার সোনালি দিন
নীলুফার ইয়াসমিন
ভাষা ভাব আদান-প্রদানের একটি মাধ্যম। মানুষ ভাষার মাধ্যমেই মনের ভাব প্রকাশ করে। ভাষার মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন করে। মানবসভ্যতার বিকাশে ভাষার অবদান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার বিকাশে যেমন ভাষা অবদান রেখেছে তেমনই সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ভাষাও বিকশিত হয়েছে। একটি ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার ভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে এশিয়া ও ইউরোপে অসংখ্য ভাষার সৃষ্টি করেছে। সময়ের সাথে সাথে যেমন অসংখ্য ভাষার জন্ম হয়েছে, তেমনি হারিয়েও গেছে অসংখ্য ভাষা।
ভাষা প্রাত্যহিক যোগাযোগের মাধ্যম। এভাবে একটি জাতির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ভাষার যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কিন্তু সে ভাষাও হারিয়ে যেতে পারে বিভিন্ন কারণে। বিশেষ করে আর্থসামাজিক কারণ এর পিছনে বেশি দায়ী। ভাষাতাত্ত্বিকগণ ভাষার এই ক্রমলুপ্তি বা হারিয়ে যাওয়াকে বলেছেন ‘ভাষার মৃত্যু’ বা ‘ভাষার বিলুপ্তি’। যখন কোনো জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের অর্থনৈতিক উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে নিজ ভাষা পরিত্যাগ করে বৃহত্তর উপযোগ বা প্রতিপত্তিসম্পন্ন ভাষা গ্রহণ করে তখন এর ক্রমলুপ্তি ঘটতে পারে। আবার ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্রতর হয়ে গেলে তার ভাষাভাষীর সংখ্যা কমে গিয়ে ভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে। এগুলো হচ্ছে সাধারণ কারণ। বিভিন্নভাবেই ভাষার মৃত্যু হতে পারে। ভাষাবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন কারণ অবতারণা করেছেন এর পেছনে।
‘মৃত ভাষা’ হচ্ছে এমন ভাষা যার স্থানীয় কোনো বক্তা নেই কিন্তু সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে এখনও ব্যবহার করা হয়। যেমন লাতিন ভাষা বা সংস্কৃত ভাষা। অনেক ক্ষেত্রে বক্তার অভাবে একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আধুনিক যুগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য ভাষা বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলিতে ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্ক’র কারণে স্থানীয় ভাষা ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে। একটি ‘মৃত ভাষা’ এমন একটি ভাষা যা কোনো সম্প্রদায়ের স্থানীয় ভাষা নয়, এমনকি এটি যদি স্বকালে ব্যবহারও করা হয়; যেমন: লাতিন বা সংস্কৃত।
২০০০-এর প্রথম দশকেও বিশ্বব্যাপী মোট প্রায় ৭০০০ ভাষা প্রচলন ছিল। এর মধ্যে বর্তমানে ক্ষুদ্র ভাষাগুলো বিলুপ্তির পথে। ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে কথিত ভাষাগুলির প্রায় ৯০% বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেসকল ভাষার ক্ষেত্রে ব্যবহার পাশাপাশি কোনো সাহিত্য খুঁজে পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে তাকে বিলুপ্ত ভাষা বলা যেতে পারে। আর বিলুপ্ত ভাষা হচ্ছে যার কোনো বক্তা নেই এবং সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিক কোনো ব্যবহারও নেই।
শেষ বক্তার শেষ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সে ভাষাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। এরকম ভাষাকেই বিলুপ্ত ভাষা বলা হয়। আমার আলোচনার বিষয় মৃত বা মৃতপ্রায় ভাষা হিসেবে ল্যাটিন এবং সংস্কৃত ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য।
বিশ্বের সমস্ত ভাষার উদ্ভব হয়েছে কয়েকটি ভাষাগোষ্ঠী থেকে। সেগুলোর মধ্যে একটি হল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে অনেকগুলো ভাষা। আর ঐ ভাষাগুলোই বর্তমান বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচলিত ভাষা। দুনিয়ার প্রাচীনতম দুটি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায় ভারতবর্ষে- একটি সংস্কৃত, অন্যটি তামিল। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল প্রায় ৩৫০০ বছর আগে। জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে মানুষ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তী দেড় হাজার বছরের মধ্যে ভাষা দুটি ভিন্ন রূপলাভ করে। একটি ‘শতম’ আরেকটি ‘কেন্তুম’। কেন্তুমবাসীরা পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে আর শতম ভাষীরা হয় পূর্বমুখী। ইংলিশ, ল্যাটিন, ইতালীয়, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষা হলো কেন্তুম ভাষার বর্তমান রূপ। ল্যাটিন হলো এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত- যা থেকে আধুনিক সব রোমান্স/রোমানীয় ভাষা ইতালি, স্পেনীয়, পর্তুগীজ, ফরাসি, রুমানীয় ভাষার জন্ম হয়েছে।
শতমের চারটি শাখার একটি ইন্দো-ইরানিক বা আর্য। ইন্দো-ইরানিক বা আর্য থেকে ভারতে আর্যজাতির আগমন আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বে। তাদের ভাষা ছিল মূল আর্যভাষা।
প্রাচীন ভারতীয় ভাষার দুইটি রূপ প্রথমটি বৈদিক বা সংস্কৃত দ্বিতীয়টি প্রাচীন প্রাচ্য। বৈদিক ভাষায় মূলত বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থাদি রচিত হতো। এ ভাষা ব্যবহারে ধর্মীয় গুরুদের বিধিনিষেধ থাকায় দ্বিতীয় রূপটি সাধারণের কথা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ছিল প্রাকৃত ভাষার ভিত্তি। আর্যদের নিকট অনার্যরা ছিল নিচু শ্রেণির মানুষ এরা আর্যদের নিকট অসভ্য বলে বিবেচিত হতো। বৈদিক গ্রন্থাদিতে অনার্যদের অস্পৃশ্য বলে উল্লেখ আছে।
ইরান, আফগানিস্তান ও তুর্কি অঞ্চলের আর্যগণ ভারতে আগমন করে। তাদের ভাষা ছিল মূল আর্যভাষা। তারা বহিরাগত হলেও আভিজাত্য ও কৌলিন্যে ভারতীয়দের শীর্ষে অবস্থান করত। স্থানীয় অনার্য অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অধিগত করে আর্যরা তাদের আর্যভাষারই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে সে আধিপত্য ক্ষুদ্র হতে থাকে। জলবায়ুগত প্রভাব ও অনার্যদের অবাধ প্রয়োগের ফলে আর্যভাষা আর শৃঙ্খলিত থাকল না। মিশ্রণ আর বিশৃংখলার ফলে আর্যভাষা তার মান হারাতে লাগল। আর্যরা ভাষা সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করল। খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে শুরু হলো ভাষা শাসনের কাজ। তাদের উদ্দেশ্য হলো একটি সর্বজনগ?্র??াহ্য, সুশৃংখল মান ভাষার প্রচলন। অতঃপর ব্যাকরণবিদ পাণিনি তার ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ভাষাকে সংস্কার করে একটি পরিশীলত রূপ দেন। এই সংস্কার জাত ভাষার নতুন নাম ‘সংস্কৃত ভাষা’।
ধ্রুপদী ভাষা প্রকারে ইউরোপের ল্যাটিন বা গ্রিক এবং ভারতের সংস্কৃত ভাষার স্থান একই। সংস্কৃতির প্রাক ধ্রুপদী রূপটি বৈদিক সংস্কৃতি নামে পরিচিত। এই ভাষা ?? ঋগ্বেদের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন রূপ। আর্য সংস্কৃতির ধারক বাহকগণ, মুনি-ঋষি, পুরোহিতবর্গ সংস্কৃত ভাষাতেই ভাব প্রকাশ করতেন। সংস্কৃত ভাষা ছিল আর্য সমাজের পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্য সমাজের ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির একমাত্র বাহন। এটি ছিল রাজ দরবারের ভাষা। এটি জনসাধারণের ভাষা ছিল না। জনসাধারণ যেমন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল তেমনি দেবদেবীর অর্চনা থেকেও বঞ্চিত ছিল। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক-বাহক সংস্কৃত ভাষা সাধারণ হিন্দুর জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে নির্দেশ ছিল- অষ্টাদশ পুরাণাদি দেশি ভাষায় অনুবাদ করলে নরকভোগ করতে হবে। তাই সংস্কৃতকে বলা হয় দেব-ভাষা। একটা বিশেষ শ্রেণি এই ভাষাকে কুক্ষিগত করে রাখায় এটি দুর্বোধ্যই রয়ে যায়। তাই এ ভাষা প্রাণের চাঞ্চল্য, চলার ছন্দ হারিয়ে ফেলে একসময়। ধুলির আস্তরণে ঢেকে যায় এর সোনালি দিন।
প্রায় ২০০০ বছর আগে এর মুক্তোঝরা দিন ছিল। আশ্রমে, তপোবনে মুনি-ঋষিদের কণ্ঠে, রাজপ্রাসাদে রাজ রাজড়াদের কণ্ঠে মন্দ্র মধুর গাম্ভীর্যে উচ্চারিত হতো এই ভাষা। এই ভাষাতেই রচিত হয়েছিল মহাকাব্য- মহাভারত ও রামায়ণ। এই দুটি পৌরাণিক মহাকাব্য যা কিনা প্রাচীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস ও জ্ঞানের আকর। যা অদ্যবধি হিন্দু সমাজের পবিত্র দুইটি গ্রন্থ। ভারতীয় সাহিত্যের মূলাধার এই দুই গ্রন্থ। যার আবেদন আজও অমলিন। এছাড়া কালিদাসের ‘মেঘদুত’, জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ সাহিত্যের ইতিহাসে অমর-অক্ষয়। সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত নাট্যকার হলেন ভাস, শূদ্রক, কালিদাস, অশ্বঘোষ প্রমুখ। ভাসের নাটক স্বপ্নবাসবদত্ত, চারুদত্ত বিষয়-বৈচিত্র্য ও শিল্পাঙ্গিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এগুলোর কাহিনী রামায়ণ, মহাভারত-আশ্রিত। শূদ্রক রচিত মৃচ্ছকটিক, কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয়, অভিজ্ঞান শকুন্তলম, শ্রীহর্ষের রত্নাবলী আজও সাহিত্যবেত্তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে।
আর্যোত্তর সমাজে শ্রেণিবৈষম্য যেমন প্রকট ছিল তেমনি সংস্কৃতিগত দ্বন্দ্বও ছিল। যেমন ঋগ্বেদে ভারতের আদিম অধিবাসীদের উল্লেখ করা হতো দাস, দস্যু বা অসুর নামে। তথাকথিত দাসদের বাস ছিল গাঙ্গেয় উপত্যকায়। সেখানে পিশাচ ও রাক্ষসদের নামও আছে। ঋগ্বেদের যুগে ভারতবর্ষ তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। ব্রহ্মাবর্ত বা আর্যাবর্ত, মধ্যদেশ এবং দক্ষিণাপথ।
আর্য সংস্কৃতির বাইরের প্রাচ্য, প্রতীচ্যের প্রতি ছিল আর্যদের বিরূপ মনোভাব। আর্যদের এই বিরূপ মানসিকতার কারণে পূর্বাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মবিরোধী মনোভাব এবং অনার্য সংস্কৃতির অস্তিত্বের প্রশ্নে জাতিভেদ বিরোধী বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে বৈদিক আর্য-সভ্যতার প্রসার বাংলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে নিকট অবস্থিত মগধের কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তখন মগদের বেদাচারহীন ব্রাত্যদের আধিপত্য ছিল। এই ব্রাত্যদের মধ্যে থেকেই জৈন ও বৌদ্ধ মতবাদের রূপান্তর ঘটে। এই ব্রাত্যদের মুখেই প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ‘প্রাকৃত’ রূপান্তর ঘটে।
ব্রহ্মাবর্ত ও আর্যাবর্তের বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বী পূর্বাঞ্চলের জীবন ও মূল্যবোধের পার্থক্য ছিল স্পষ্ট। স্বয়ং বুদ্ধদেব সংস্কৃতের পরিবর্তে প্রত্যেককে নিজ নিজ মাতৃভাষায় তার বচন পঠন-পাঠনের উপদেশ দিয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষা ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একমাত্র বাহন আর জৈন বা বৌদ্ধরা জনসাধারণের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা বা প্রাকৃতের ব্যবহার করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের বৌদ্ধ হীনযানীরা গ্রহণ করলেন পালি, উত্তর ভারতের বৌদ্ধ মহাযানীরা গ্রহণ করলেন সংস্কৃত-প্রাকৃত মিশ্রিত এক সংকর বা গাঁথা ভাষা।
সমাজে তখন একটা আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল। আর্য ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের জনসাধারণের প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টির বিপরীতে সমাজে একটা আন্দোলন চলছিল। শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজের চিন্তা, ধারণা নিয়ে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এটা ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মাদর্শের বিরুদ্ধে একটা ব্যাপক আন্দোলন। বৌদ্ধ দর্শনের অনুসারীরা সমাজের ব্রাত্য শ্রেণির মানুষের পাশে যেমন দাঁড়ালেন, তেমনি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আনলেন আমূল পরিবর্তন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন সংস্কৃত ভাষা ছাড়া প্রকাশ সম্ভব নয় এই নিয়মে তারা কুঠারাঘাত করলেন। বৌদ্ধ অনুসারীগণ পালি প্রাকৃত ভাষায় গ্রন্থ রচনা শুরু করলেন। সহজবোধ্য কথ্য ভাষায় রচিত হতে লাগলো সাহিত্য, দর্শন শাস্ত্র।
ভাষা চলা শুরু করলো ছলাৎ ছলাৎ ছন্দে। সংস্কৃত ততদিনে স্তিমিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্রোতহীন সরোবরে আটকা পড়ল সংস্কৃত। রক্ষণশীলতার আবরণে আচ্ছাদিত সংস্কৃতের সোনাঝড়া দিনগুলোতে ধুলোর আস্তরণ পড়ে গেল। মানুষের মনের ভাব সহজ ভাষাতেই প্রকাশ করতে চায় তাই জনসাধারণের মুখের ভাষা কথ্য বহমান নদীর মত চলতে লাগলো। অপরদিকে বিশেষ শ্রেণির ভাষা দেবভাষা সংস্কৃত মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
সংস্কৃত সাহিত্যের ভান্ডার কথ্য ও নাটকের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধশীল ধারা দুটি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক রচনায় সমৃদ্ধ সংস্কৃত ভাষা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। হিন্দুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সংস্কৃত হলো আনুষ্ঠানিক ভাষা। হিন্দু ধর্মের স্তব-স্তোত্র ও মন্ত্র সবই সংস্কৃতে লিখিত। পূজা ছাড়াও বিবাহ, অন্নপ্রাশন, মৃতের সৎকার ইত্যাদিতে সংস্কৃত শ্লোকাদি ব্যবহৃত হয়।
সংস্কৃত সাহিত্যের গুরুত্ব আজও অমলিন। রামায়ণ, মহাভারতের অনেক উপাদান নিয়ে আজও নাটক, কবিতা, গল্প উপন্যাস রচিত হয়।
টেলিভিশন, সিনেমায় রামায়ণ মহাভারত, ভাগবত গীতার কাহিনী নিয়ে মুভি, সিরিজ নাটক প্রদর্শিত হচ্ছে অহোরহ। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষার সাহিত্য দর্শন পঠিত হচ্ছে। কিন্তু তা কেবল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দর্শন জ্ঞানলাভের জন্য। এছাড়া ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারত সরকার। কিন্তু এই সময়ে এসে এই দুর্বোধ্য, জটিল বৈয়াকরণিক ভাষা কথ্য ভাষা হিসেবে চালানো সম্ভব নয়। সংস্কৃতের সাথে কথ্য ভাষা মিলে সংস্কৃত ভাষারও রূপ পরিবর্তন হয়েছে। তবে ভারতবর্ষের অনেক ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষাও সংস্কৃত ভাষার নিকট ঋণী। সংস্কৃত ভাষার প্রচুর শব্দ, উপসর্গ, প্রত্যয় বাংলা ভাষায় এসেছে। আর এই সকল মাধ্যম এবং প্রচেষ্টায় সংস্কৃত ভাষা আমাদের মাঝে জীবন্মৃত হয়ে থাকবে।
ল্যাটিন ভাষার জন্ম হয় রোমান সাম্রাজ্যে। ১৫০ থেকে ১০০ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যে মেধাবী লেখক ও ব্যাকরণবিদদের হাতে ক্লাসিক্যাল লাতিন ভাষার বিকাশ ঘটে। এ সময়ে সিসেরো, সিজার, ভার্জিল প্রমুখ লেখকগণ লাতিন ভাষায় ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা করেন। সাহিত্যিক লাতিন ভাষাটি প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত ভাষার মতোই স্থির হয়ে যায় এবং এর তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না?। প্রাচীন ভারতে অনঢ় ও অপরিবর্তনীয় সংস্কৃত ভাষার বিপরীতে উদ্ভব হয়েছিল পালি ও প্রাকৃত ভাষা যা ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। তেমনি লাতিন ভাষার পাশাপাশি জন্ম হয়েছিল প্রাকৃত ল্যাতিন বা ভালগার ল্যাতিন।
আদি লাতিন ভাষার সময়কাল ২৫০-১৫০ খ্রিষ্টপূর্ব। ল্যাতিন ভাষা কিন্তু প্রাচীন ইতালির স্থানীয় ভাষা ছিল না। ইটালিক জাতি উত্তর দিক থেকে এসে ইতালীয় উপদ্বীপে এ ভাষা নিয়ে আসে। ৬০০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে লাতিন মৃত ভাষায় পরিণত হয়। এর মানে এ ভাষায় আর কেউই কথা বলে না। তবে লাতিনের গুরুত্ব একেবারে হারিয়ে যায়নি। এর থেকে এখনো নতুন শব্দ ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় নেওয়া হচ্ছে।
১৫শ ও ১৬শ শতকে আধুনিক লাতিনের আবির্ভাব ঘটে। রেনেসাঁস যুগের লেখকেরা লাতিন ভাষায় উচ্চমানের গ্রন্থ রচনা করেন। এক্ষেত্রে ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন, পদার্থ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের কাজ উল্লেখযোগ্য। ১৮ শতক পর্যন্ত পাণ্ডিত্য ও কূটনৈতিক ভাষা ছিল ল্যাটিন। কেবল ১৭শ শতকের শেষে এসেই আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে লাতিনের ব্যবহার উঠে যায়। ২০ শতক অবধি রোমান ক্যাথলিক ধর্ম শাস্ত্রে লাতিন ভাষার প্রভাব অব্যাহত ছিল।
৩৫০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য রোমান সাম্রাজ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপজুড়ে বিস্তারলাভ করেছিল। রোমান সাম্রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রাকৃত ল্যাটিন ভাষায় কথা বলত।
পাশাপাশি রোমান সাহিত্যিকরা ধ্রুপদী, ল্যাতিন ভাষায় সাহিত্য রচনা করতেন। প্রশাসনিক ও শিক্ষা-দীক্ষায় মাধ্যম হিসেবে পশ্চিম ইউরোপে ল্যাটিন একটি গ্রহণযোগ্য ভাষায় পরিণত হয়।
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়। প্রাকৃত ল্যাটিন ভাষার বিবর্তন ঘটতে থাকে?। প্রাকৃত ল্যাটিন থেকে উদ্ভব ঘটে রোমান্স ভাষার। প্রাকৃত পক্ষের প্রাকৃত ল্যাটিনের বিবর্তিত রূপ রোমান্স ভাষা। রোমান্স ভাষা হয়ে ওঠে লিঙ্গুয়া রুমানা এবং ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, উত্তর আফ্রিকা, সার্দিনিয়া ও কর্সইকা পর্যন্ত ছিল রোমান্স ভাষার বিস্তার। রোমান্স শব্দটি এসেছে ল্যাটিন রোমানিস থেকে।
এর মানে কথা বলা। ক্রমশ ক্লাসিক্যাল ল্যাটিন সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে রয়ে গেল। সাধারণ মানুষ বলতে লাগলো রোমান্স ভাষায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ অব্দ থেকে ১৪ খ্রিষ্ট পর্যন্ত ছিল ল্যাটিন ভাষার স্বর্ণযুগ। তখনকার রচনাবলীর মধ্য ইউলিযুস কাইসার, কিকেরো এবং লিভির লেখা গদ্য এবং লোক্রেতিযুস, ভার্জিল, হোরাকে এবং ওভিদের লেখা কাব্য। এ পর্বে গদ্য ও পদ্য উভয় ক্ষেত্রে ল্যাটিন ভাষা ভাব প্রকাশের জন্য একটি উৎকৃষ্ট, সমৃদ্ধ শৈল্পিক মাধ্যমে পরিণত হয়। রোমানদের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষা ছিল এমন একটি জাতীয় কাব্য রচনা করা যাতে গ্রিকদের সমকক্ষ হতে পারে। তাদের সেই আকাক্সক্ষা ভার্জিলের ঈনিড’ কাব্যে পূর্ণ হয়েছিল। গ্রিক সাম্রাজ্যের পতনের পর রোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে রোমানরা চেয়েছিল গ্রিকদের সাহিত্য, দর্শন ও সংস্কৃতির মতো তাদের সাহিত্য সংস্কৃতিও উচ্চপর্যায়ের হোক। আদি লাতিন ভাষায় গ্রিক ভাষার তুলনায় সৌন্দর্য ও নমনীয়তা কম ছিল। এর শব্দ ভান্ডার ছিল সীমিত। তাই তারা গ্রিক থেকে বহু শব্দ ধার করে।
লাতিন ক্রমান্বয়ে এক ধরনের আভিজাত্য অর্জন করে। ল্যাটিন ভাষা গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা প্রকাশের ভাষা হিসেবে বহু শতাব্দী ধরে সমাদৃত। আধুনিক বিশ্বের আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি হলেও ইংরেজি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লাতিন ভাষা থেকে বহু ঋণ গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। ইংরেজি শব্দের উৎস খুঁজতে গেলে ল্যাটিনকে খুঁজতে হয়।
আধুনিক ইউরোপের অনেক ভাষার ইতিহাস ল্যাটিনের ইতিহাসের সাথে জড়িত। বিশ্বায়ন, মুক্ত বাণিজ্য, অন্তর্জাল আর তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে আমরা ইংরেজিনির্ভর হয়ে গেছি গোটা মানবসমাজ। এর মধ্যেই আমাদের মাতৃভাষাকে শীর্ষে রেখে, শুদ্ধ ব্যবহার ও প্রতিনিয়ত পরিচর্যার মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং বিস্তৃতিসাধন করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, টাঙ্গাইল
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ