গত ৫ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি, কেন্দ্রীয় নেতা এবং জেলা-থানা ও ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অফিস-বাসা ও কলকারখানায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। শুধু তাই নয়, আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়া হয় বাড়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এতে আত্মগোপনে চলে যায় সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ স্ত্রী-সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ী কিংবা পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। ফলে কোথায়ও নেই টানা ১৬ বছর যাবত ধাপটের সঙ্গে রাজত্ব করা দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও। এতে কখনো দলটির নেতৃত্ব আবার কখনো নেতাদের প্রতিবাদ-বিবৃতি নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে গুজব। এককথায় বলতে গেলে দীর্ঘদিন ক্ষমতার স্বাদ নেয়া দলটির নেতাদের পলায়নের ফলে গুজবে ভাসছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির প্রধানের দেশ ছেড়ে পালানোর পর আতঙ্ক আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ে চলে যায় নেতাকর্মীরাও। এরপর গত একমাসের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার মতো কাউকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা গুজব ও অপপ্রচার প্রতিদিনই ডালপালা গজাচ্ছে। এ গুজবের পরিসর দিনকে দিন বাড়ছেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ভিত্তিহীন সংবাদ তৈরি করে তা ফেসবুক ও ইউটিউবে ছেড়ে দিয়ে কর্মীদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলছে।
অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের নামে গুজব : গত শুক্রবার সকাল থেকে ফেসবুকে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক স্বাক্ষরিত এ চিঠিটি ভাইরাল হয়। সেখানে শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানানো হয়। চিঠিতে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে। সদস্য সচিব করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে। ভাইরাল চিঠিতে লেখা রয়েছে, বিশ্বমানবতার জননী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। তিনি চলে যাওয়ার পর সারা দেশে জামায়াত-বিএনপির দোসররা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের শিকার হয়েছে মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এতে মনোবল হারিয়ে ফেলেছে তৃণমূল পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। বিরাজমান পরিস্থিতিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা বা তার সুযোগ্য পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় কারো পক্ষেই দেশে এসে দলের হাল ধরা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় দলকে পুনর্গঠন করতে ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলো। পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি কার্যকর থাকবে। তবে সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করার নামে ফেসবুকে যে চিঠি ভাইরাল হয়েছে সেটিকে গুজব বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
নাছিমের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে : আওয়ামী লীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, প্রিয় দেশবাসী, দেশ এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। আমরা এক মঘের মুল্লুকে বাস করছি। আমরা বিশ্বাস করি, শিগগির আঁধার কেটে যাবে। বাংলাদেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে পরিচালিত হবে। শুক্রবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করার নামে ফেসবুকে যে চিঠি ভাইরাল হয়েছে, সেটিকে গুজব উল্লেখ করে দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বিবৃতিও দিয়েছেন বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনিই আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো সংগঠন নয়। আওয়ামী লীগ এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। এ দলের নেতৃত্বে আছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। ফলে কারও অপপ্রচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। তিনি বলেন, দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত আপনারা দায়িত্বশীল নেতাদের মাধ্যমে জানতে পারবেন। কোনো ষড়যন্ত্রকারীর কথায় কান না দিয়ে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করাই এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রধান কাজ।
আপা পালাইছে, মানতেই কষ্ট হয় : গত ৫ অগাস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শীর্ষ নেতারাও অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ ‘দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে’ গ্রেফতার হয়েছেন। প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতেও শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানো মেনে নিতে পারছেন না দলের বহু নেতা। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে একটি গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে শেখ হাসিনা পলায়ন করেছেন। তখন এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনা পালায় না। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, শেখ হাসিনা নাই, শেখ হাসিনা চলে গেছে, শেখ হাসিনা পালায় না, গত ২৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে বলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। অথচ এ ঘটনার ঠিক ১০ দিন পরে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসার পর গত ৫ অগাস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান, যা এখনও মানতে পারছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। এ নিয়েও নেতিবাচক ভিত্তিহীন সংবাদ তৈরি করে তা ফেসবুক ও ইউটিউবে ছেড়ে দিয়ে কর্মীদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আত্মগোপনে থাকা বেশ কয়েকজন নেতা। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলার এক নেতা বলেন, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না। আপা পালাইছে, মানতেই কষ্ট হয়। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন, জানেন। যারা কাছ থেকে তাকে দেখেছেন, তারা কেউই এটা মানতে পারবে না। কারণ উনি মোটেও পালিয়ে যাওয়ার মানুষ না। আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশ ছেড়ে না গেলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো বলেও মনে করেন তিনি। ওই নেতা বলেন, আপা দেশে থাকলে নেতাকর্মীরা মনে বল পেতেন। ফলে দলে অন্তত এখনকার মতো বিপর্যয় দেখতে হতো না। বিচারের মুখোমুখি হতে হলেও এখন শেখ হাসিনার দেশে ফেরা উচিৎ বলেও মনে করেন তিনি। আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, আমি মনে করি, আপার দ্রুত দেশে ফিরে আসা উচিৎ। উনি দেশের মাটিতে পা রাখলেই দেখবেন নেতাকর্মীরা আবার সব জেগে উঠেছে। একই কথা বলেছেন তৃণমূলের আরেক নেতা। তিনি বলেন, ক্ষমতা হারানোর পর খালেদা জিয়া ছাড়েননি, এমনকি এরশাদের মতো স্বৈরাচারও পালায়নি। সেখানে নেত্রী কেন দেশ ছাড়লো, সেটাই আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
* আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের চিঠিটি গুজব * আওয়ামী লীগ নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে Ñনাছিমের অভিযোগ * আপা পালাইছে, মানতেই কষ্ট হয় Ñতৃণমূলের কর্মীরা
গুজবে ভাসছে আওয়ামী লীগ
- আপলোড সময় : ০৮-০৯-২০২৪ ০২:৩০:১৮ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৯-২০২৪ ০২:৩০:১৮ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ