সপ্তাহ খানেক ধরে দেশে যে বন্যা চলছে তাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি আছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার। দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম এ তথ্য জানান। এদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে হাহাকার। আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বজনের বাড়িই যেন বানভাসিদের ঠিকানা। বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় খাবার সঙ্কট চরমে।
গতকাল সচিবালয়ে ত্রাণ উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টি আছে। ১১ জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন। পানিবন্দি পরিবার ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি। এখন পর্যন্ত বন্যায় মোট ২৭ জন মারা গেছে জানিয়ে দুর্যোগ উপদেষ্টা বলেন, এর মধ্যে কুমিল্লায় ১০ জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছেন।
এদিকে টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রধান সড়কের আশপাশে সহযোগিতা পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সঙ্কট। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি ক্ষুধার্ত অধিকাংশ শিশু। ফলে অধিকাংশ জায়গায় দেখা দিয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১ হাজার ১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন দুই লাখ ১৬ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ৮৮২ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যার পানি। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণই এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে বন্যার্ত মানুষ সীমাহীন কষ্টে দিন যাপন করছেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জয় কৃষ্ণরামপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিধবা হোসনে আরা। তিনি বলেন, এখানে থাকার মতো, ঘুমাবার মতো অবস্থা নেই। আল্লাহ আমাদের এভাবে রাখছে। একটা কাপড় একটা জামা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আইসি। আমার সামর্থ্য নাই ঘরবাড়ি করার। ছেলেরাও গরিব। কিচ্ছু করতে পারবে না তারা।
সাহেরা খাতুন নামে আরেকজন বলেন, রোডে-ঘাটে (রাস্তায়) পানি। আমাদের স্বামীরা কর্ম করতে পারে না। আমরা এখন আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। অনেক কষ্ট করে আছি। কেউ খোঁজ-খবর নেয় না। আমরা এখন কীভাবে বাঁচবো জানি না। আমরা সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা চাই। অনেকে সহায়তা পায় শুনি, কিন্তু আমরা চোখে দেখি না। আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে উপোস থাকি। কোনো উপায়ে আমরা সাহায্য পাই না। বন্যা না কমলে সব শেষ হয়ে যাবে উল্লেখ করে বৃদ্ধা শাহ আলম বলেন, এত পানি আমি ’৭০ সালেও দেখি নাই। ২০২৪ সালে পানি আর পানি। আমাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। যদি বন্যা না কমে, আমাদের ঘর বাড়ি সব উল্টে যাবে।
বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিটা ইউনিয়নে সচিবদের সঙ্গে ছাত্রদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা দুর্গত এলাকাগুলোতে সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসে ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন। সেই হিসাবগুলো আমাদের কাছে নেই। তবে যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, আমরা প্রতিটা ইউনিয়ন অনুযায়ী তা বন্ধন করছি। তাছাড়া যদি কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে সেগুলো আমরা লিখে রাখছি। পরে সেসব এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করছি।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রথমে আমাদের খাবারের একটু সমস্যা ছিল। এখন আমরা পর্যাপ্ত শুকনো খাবার পাচ্ছি। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা আসছে, ব্যক্তিগতভাবে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসছে। তাছাড়া সরকারিভাবে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ৮৮২ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
এছাড়া লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বজনদের বাড়ি উঠেছেন। অনেকে আবার কষ্ট করে হলেও অবস্থান করছেন বাড়িতে। চারদিকে পানি থাকায় খাটের ওপর থাকছেন, আর সেখানেই চলছে রান্নাবান্না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার লামচরী, মধ্য বাঞ্চানগর, শিশু পার্ক এলাকা ও লাহারকান্দি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি। এসব এলাকার ১২ হাজার ৭৫০ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। তবে অধিকাংশ মানুষ নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে স্বজনদের বাড়ি গিয়ে উঠেছেন।
অপরদিকে ফেনী জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া বাড়ি-ঘর ও এলাকাগুলোতে পানি কিছুটা কমেছে। তবে যে ক্ষত তা থেকে উঠা এখনো সম্ভব হয়নি। এলাকাগুলোতে এখনো ঘরে ফেরার উপক্রম হয়নি। নতুন করে মুছাপুরে ক্লোজার ভেঙে যাওয়ায় চর এলাকার বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বেড়েছে ভিড়। গতকাল আমাদের ফেনী প্রতিনিধি সরেজমিনে দাগনভূঞা উপজেলার দাগনভূঞা বাজার, বেকের বাজার, সিলোনিয়া বাজার, ফাজিলের ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন বড় মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, কলেজ ও বহুতল ভবনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া প্লাবিত এলাকার বহুতল ভবনেও আশ্রয় নিয়েছে এলাকার বাসিন্দারা। ব্যবস্থা হয়েছে হেলথ ক্যাম্পেরও।
জানা গেছে, এখানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও বিত্তশালীরা এগিয়ে এসেছে মানুষের উপকারে। বিভিন্ন জন থেকে অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে খাবার ব্যবস্থা করছে আশ্রয় নেয়া মানুষের জন্য। ভলেন্টিয়াররা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। খাবার প্যাকেজিং করছে। কেউ ট্রাকে করে নৌকা করে পৌঁছে দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন জায়গায় চুলা বসিয়ে আয়োজন করা হয়েছে রান্না-বান্নার।
স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাগনভূঞা বাজারে উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া এখানকার বিভিন্ন বহুতল বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে অনেক মানুষ। তাদের তিনবেলা খাবার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখানকার প্রতিনিধিদের।
দাগনভূঞাঁ উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক ইদ্রিস রিয়াদ জানান, এখানকার আশ্রয়কেন্দ্রে প্রচুর মানুষ আছে। গতকাল আরও বেড়েছে। এখানে বাজারে পানি উঠেনি। এই এলাকা উঁচু দেখে সবাই এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তবে বাজার ছাড়া আশপাশের সব এলাকাই প্লাবিত। প্রথম দিকে ভেতরে গিয়ে খাবার দিতে কষ্ট হয়েছে। এখন সবার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে। তিনি জানান, এখন সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে খাবারের সঙ্কট। বাড়ি-ঘরে নিজস্বভাবে যা রান্না-বান্না করতো তাদেরও সামর্থ্য ফুরিয়ে এসেছে। আজ পর্যন্ত খাবার ব্যবস্থা করা যাবে। এরপর থেকে কী ব্যবস্থা হবে সঠিক জানা নেই। সবার কাছে অনুরোধ এখন এদিকে ত্রাণ নিয়ে আসলে মানুষগুলোর খাবারের ব্যবস্থা হবে। বিভিন্ন এলাকায় খাবার বা ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় এমন ঘটনাও ঘটেছে আমাদের ওপর তেড়ে এসে ত্রাণ নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, এখনো উপজেলার উত্তর দিক খুশিপুর, নেয়াজপুর, রাজাপুর, প্রতাপপুর এলাকা এখনো গলা সমান পানিতে। অন্যদিকে নতুন করে উপজেলার দক্ষিণ দিকে, আলিপুর, চৌধুরী হাট এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলা জামায়াতের আমির গাজী ছালেহ উদ্দিন বলেন, আমাদের উপজেলা থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যোগাযোগ করে খাবার পাঠাচ্ছি। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। বিভিন্ন মানুষ আমাদের এনে দিচ্ছে আমরা সমন্বয় করছি। তবে এখন ত্রাণের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বাজারে খাদ্যের তত্ত্বাবধানে থাকা ভলেন্টিয়াররা জানান, প্রতিদিন খাবার রান্না করে দেয়া এবং অন্যান্য সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো খরচ হচ্ছে শুধু বাজার ও এর আশপাশের ভবনে খাবার ও শুকনো খাবার, ওষুধপত্র ও যাতায়াত মিলিয়ে। এখন খাবারের ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত আছে। তবে আশা করি মানুষজন এগিয়ে আসবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

বন্যা পরিস্থিতি : ৩০ হাজারের বেশি পরিবার পানির বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন * এখনো পানিবন্দি ১২ লাখ পরিবার * বন্যায় মারা গেছেন ২৭ জন * প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাবার সঙ্কট চরমে
কমেছে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা, বেড়েছে মৃত্যু


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ