ঢাকা , শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫ , ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
সরকার সংস্কার কমিশন করলেও নদীর ক্ষেত্রে প্রতিফলন নেই-আনু মুহাম্মদ বাড্ডায় কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে নিহত ১ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিপুল খরচেও কমানো যাচ্ছে না নানামুখী আতঙ্ক রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সেই শিশু আছিয়া না ফেরার দেশে ধর্ষণে আতঙ্ক -উদ্বেগ ভারতকে অযাচিত বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বলল ঢাকা প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরে যাচ্ছেন ২৬ মার্চ সালমান এফ রহমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা খরায় পুড়ছে চা-বাগান উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা ইফতারিতে দই-চিড়ার জাদু একরাতে দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা এলাকায় আতঙ্ক স্বাভাবিক নিত্যপণ্যের বাজার, সংকট সয়াবিনে মামলা থেকে স্বামীর নাম বাদ দেয়ার কথা বলে স্ত্রীকে ধর্ষণ ছেঁউড়িয়ায় শুরু লালন স্মরণোৎসব দোহাজারীতে বাসচাপায় ৩ জন নিহত হেনস্তার পর ছাত্রীকে ফেলে দিলো দুর্বৃত্তরা ৫৬০ মডেল মসজিদ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ভ্যাট দেয় না বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরনের কাপড় টিভি ফ্রিজ খাট টাকা সব পুড়ে শেষ বস্তিতে আগুন

​দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে আওয়ামী লীগের পতন

  • আপলোড সময় : ২৫-০৮-২০২৪ ০৪:০৭:১৭ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৫-০৮-২০২৪ ০৪:০৭:১৭ অপরাহ্ন
​দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে আওয়ামী লীগের পতন
জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণে সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তৃণমূল আওয়ামী লীগের গৃহবিবেদ শুরু হয়। তারা পরিবারতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি। জাতীয় সংসদসহ সকল নির্বাচনে এমপিদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগ্নেসহ আত্মীয়-স্বজনও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেন এবং জোরপূর্বক জয়ী করেন। এতে অনেক ত্যাগী-পরীক্ষিত দাপুটে নেতারাও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে কোনো ভূমিকা রাখেননি। বরং উল্টো তাদের ভূমিকা ছিল নীরব ও অভিমানের। কমিটি গঠনে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে পদ-পদবি ভাগাভাগি নিয়ে একধরনের যুদ্ধ শুরু হয়। তবে তৃণমূলে দলের দুঃসময়ে ভূমিকা রাখা নেতাদের বাদ দিয়ে সুযোগ-সন্ধ্যানীদের কমিটিতে পদ-পদবি দেয়ায় ক্ষোভ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শেখ হাসিনার পতনের প্রায় ৩ মাস আগেই সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এ কারণে জুলাই-আগস্টে রাজপথে বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে জোড়ালো ভূমিকা রাখেনি নিষ্ক্রিয় নেতারা। ফলে দ্রুত সময়ে পতন ঘটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের।
গণঅভ্যুত্থানে যেসব কারণ ভূমিকা রেখেছে: চলতি বছরের পাঁচই জুন যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয়, তখন কারো ধারণাই ছিলো না যে পরের দুই মাসের মধ্যে সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটবে। শেষ পর্যন্ত এটি শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের টানা শাসন অবসানের দিকে নিয়ে গেছে। সেদিন হাইকোর্টের সেই আদেশটি অনেক পত্রিকায় তেমন গুরুত্বও পায়নি। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহের মাথায় সেই বিক্ষোভের জেরে এক সময় ১৬ বছর ধরে কঠোরভাবে বিরোধী দলকে দমন করে একটানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনাকে গোপনে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়। আন্দোলনটি শুরুতে ছাত্রদের কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এর সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, নানা বয়সের লাখো মানুষ অংশ নিতে শুরু করে। প্রথমবারের মত আন্দোলন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়া দলটির আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে কোনো দিক নির্দেশনাও পাঠাননি প্রায় তিন সপ্তাহে। বেপরোয়া হামলার মুখে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, নেতাকর্মীরা পলাতক, একসঙ্গে বসার মতো কার্যালয়ও নেই বললেই চলে, প্রায় সবগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরেও গোপালগঞ্জ ছাড়া তারা রাজপথে সেভাবে সক্রিয় হতে পারছেন না কোথাও।
কুমিল্লায় পরিবারতন্ত্রের অবসান: সরকার পতনের পর এবার কুমিল্লার ১০ উপজেলায় অবসান হয়েছে পরিবারতন্ত্রের। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে উপজেলা, সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অপসারণের পর ঘটে এই অবসান। সরকারের ক্ষমতা পরিবর্তণের সঙ্গে বদলে গেছে মসনদের রাজত্ব্য। বিচ্যুতি ঘটেছে পারিবারিক নেতৃত্বের। কুমিল্লা-৬ আসনের টানা চারবারের এমপি ছিলেন আ ক ম বাহাউদ্দিন। এ বছরের গেল ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন তারই জ্যেষ্ঠ কন্যা ডা. তাহসীন বাহার সূচনা। কুমিল্লা-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আব্দুল মজিদ। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন তিনি। এ আসনের হোমনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তার স্ত্রী রেহানা মজিদ। কুমিল্লা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম সরকার। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন তিনি। মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন তার ছেলে আহসানুল আলম সরকার কিশোর। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন আবুল কালাম আজাদ। পরবর্তীতে তার ছোট ভাই মামুনুর রশীদ, নির্বাচিত হন দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে। ২০২০ সালে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান আবু তাহেরের মৃত্যুর পর উপ নির্বাচনে জয়ী হন এম এ জাহের। এর চার বছর পর জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা-৫ আসনে হন সংসদ সদস্য। আর ওই ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান হন তারই ভাতিজা আবু তয়্যইব অপি। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সাবেক স্বরাস্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের শ্যালক হামিদ লতিফ ভূঁইয়া কামাল। কুমিল্লা-৯ আসনে টানা চারবারে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মো. তাজুল ইসলাম। ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী। মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদে দুই মেয়াদে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন, তার ভাতিজা মো. আমিরুল ইসলাম। শুধু তাই নয়, তাজুল ইসলামের শ্যালক মহব্বত আলী টানা তিনবার লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। লালমাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাতিজা কামরুল হাসান শাহীন। এছাড়া তার ছোট ভাই গোলাম সারোয়ার তিন মেয়াদে দক্ষিণ উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ছিলেন।
দীর্ঘদিনের ক্ষোভে আ’লীগের পতন: ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে আর দলটি ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি। একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে দলটির টিকে থাকা এই পতনের পেছনে মূল কয়েকটি কারণ হিসেবে উঠে আসছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, এই ১৫ বছরে বেশিরভাগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা নিজেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের যে ক্ষমতার ভিত্তি, তার কোনটাই টেকসই ছিল না। কারণ তারা জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে মানুষের একটা ক্যাটালিস্ট বা স্ফুলিংগের দরকার ছিল। সেটাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। সরকার বিরোধী একটা আন্দোলন যখন জোরালো হয়ে ওঠে, সেই আন্দোলন ঘিরেও মানুষের ক্ষোভের জন্ম হয়, তখন সেনাবাহিনী, কারফিউ বা পুলিশের পরোয়ানা না করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ গণভবনের উদ্দেশ্যে পথে নেমে এসেছিলেন বলেন জানান তিনি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ১৫ বছরের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, জিনিসপত্রের দাম, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, ব্যাংকিংয়ের অনিয়ম সব কিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ কোটা আন্দোলনের একটা উপলক্ষ্য করে একটা পরিবর্তনের আশায় নেমে এসেছে। সেই আন্দোলনে অংশ নেয়া তাহমিনা আক্তার বলেছিলেন, আমার সরকারি চাকরির দরকার নেই, চাকরির আবেদন করার মতো বয়সও নেই। কিন্তু আমাদের সাথে যে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, আমাদের যে ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হচ্ছে, সেটার অবসান চাই। সেটার জন্যই আজ আমি পথে নেমে এসেছি। গণঅভুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের পেছনে আরো কিছু কারণ দেখছেন বিশ্লেষকরা।
ভোটের আর মতপ্রকাশের অধিকার: গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ বাস্তবে কার্যত একটি ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারে পরিণত হয়েছিল। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুইটি হয়েছে অনেকটা একতরফা নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও সেখানে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল, যে নির্বাচনকে ‘রাতের নির্বাচন’ বলেও অনেকে বর্ণনা করেন। এমনকি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। সেসব নির্বাচনও বেশিরভাগ সময় একতরফা হয়েছে। যেখানে বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে, সেখানেই অনিয়ম বা কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ফলে গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার বা মতামত জানানোর কোন অধিকার পায়নি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ যেটা করেছে, জোর-জবরদস্তি করে একটা কতৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করলো। জনগণের কোন রায় তারা নেয়নি। ফলে জনগণের সমর্থনও ছিল না তাদের পেছনে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জবরদস্তি করে ভুয়া নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী দলকে শক্ত হাতে দমন করার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এসব দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ শত শত নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে, মামলা বা সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে।
মানবাধিকার হরণ ও ভয়ের সংষ্কৃতি: আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এ বছরের শুরুতেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক অভিযোগ করেছিলেন যে, মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বিরোধী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিরুদ্ধ মত দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। বিরোধী গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, দখল নেয়া হয়েছে অথবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশে গত বহু বছর ধরে সামাজিক মাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিব বিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। এই দমনের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়ার জের ধরে মাসের পর মাস ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যেসব মামলায় গত ১৬ বছরে জামিন হয়নি, সরকার পরিবর্তনের পর এক রাতের মধ্যে সেসব মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এসব রাজনৈতিক দলের শত শত কর্মী। জামিন দেয়ার সময় বিচারক মন্তব্য করেছেন, অনেক কথা আছে যা আমরা বলতে পারি না। বছরের পর বছর বিরোধীদের ধরে নিয়ে হয় গুম করে দেয়া হয়েছে না হলে আটকে রাখা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এরকম কয়েকজন ব্যক্তি মুক্তিও পেয়েছেন, যাদের আট বছরের বেশি সময় ধরে কোন অভিযোগ ছাড়াই গোপনে আটকে রাখা হয়েছিল। ফলে মানুষ যে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি, ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে, তা থেকে মুক্তি পেতেই গণআন্দোলনে সবাই নেমে এসেছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভর একটি দল: বিভিন্ন দেশের ইতিহাসেও দেখা গেছে, জোর করে ক্ষমতায় থাকা দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এক সময় আমলা, প্রশাসন বা পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। তাদের মতে, টানা বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে এক সময়ের মাঠের রাজনৈতিক দল হলেও দলটির নেতাকর্মীরা জনগণের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দলটি। বিশেষ করে দলটি পুরোপুরি প্রশাসন ও আমলা নির্ভর হয়ে উঠেছিল। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব নেতাদের পদ দেয়া হতো, অভিযোগ রয়েছে যোগ্যতার বদলে বরং স্বজনপ্রীতি বা অর্থের বিনিময়ে এসব পদ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পদ বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন অনেক ব্যক্তিকে সুযোগ দেয়া হয়েছে যাদের অতীতে রাজনীতির সাথে কোন সংস্রব ছিল না। তাদের অনেকেই এসব পদকে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করেছে। সাংবাদিকসহ পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এমনভাবে দলীয় বিস্তার ঘটানো হয়েছে যাতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আসল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নামে, আওয়ামী লীগের নামে তাদের নেতাকর্মীরা যা করেছে, তাতে মানুষের ক্ষোভ জমতে জমতে এমন একটা অবস্থায় গেছে, এবার শুধু সেটার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। গুলিতে যখন অনেক মানুষ মারা গেছে, তখন তাদের গুলিতে মৃত্যুর ভয়ও চলে গেছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, যেসব বাহিনীর ওপর নির্ভর করে সরকার ক্ষমতায় টিকে ছিল, সেইসব বাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। তাদের শীর্ষ পদগুলো থাকা ব্যক্তিরা যেমন এসব ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো বাহিনী পরিচালনা করেছেন, আইন বা নিয়মের ধার ধারেননি। তেমনি দুর্নীতির করে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ওসি-কমিশনার নিয়োগ: রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় থানার ওসি থেকে শুরু করে কমিশনার পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দলীয় সম্পৃক্ততার অভাবে অনেক কর্মকর্তা অবহেলিত থেকেছেন। এসব কারণে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর অনেকের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরোধী একটি মনোভাব তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তাদের একটি বিজ্ঞপ্তিতে যেমন দাবি করা হয়েছে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজে ব্যবহার করেছেন। বাধ্য হয়ে তাদের সেসব নির্দেশ মানতে হয়েছে।
দুর্নীতির অর্থে বেগমপাড়ায় বাড়ি: আওয়ামী লীগের সরকার তাদের ইশতেহারে ও নেতাদের বক্তব্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা ঘোষণা করে আসলেও গত তিন মেয়াদে এই দলের ছোট থেকে কেন্দ্রের বেশিরভাগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে কানাডায় বাংলাদেশিদের পরিবাবের সদস্যদের নিয়ে ‘বেগমপাড়া’ তৈরি হওয়ার মতো খবর এসেছে। অনেক নেতা-মন্ত্রী-এমপি, সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন, বিনিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের মতো অনেক সরকারি সাবেক কর্মকর্তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ তৈরির খবর প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। সরকারি অফিসে ঘুষ দেয়া যেন একটা স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রীর, সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দেশে বিদেশে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, বিনিয়োগ স্কিমে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মানুষ ভালো চাকরি পেতে চেয়েছে, যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে যাতে নিরাপদ থাকতে পারে। আগে প্রাইভেট সেক্টরে অনেক ভোলো চাকরি ছিল, সেই সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে তারা সবাই সরকারি চাকরি পেতে চাইছিল। কিন্তু সেই চাকরির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও তারা নানা অনিয়মের মুখোমুখি হয়েছে।
তড়িঘড়ি করে নিষিদ্ধ হয় জামায়াত: আন্দোলনের নেপথ্যে ‘জামায়াত-শিবির রয়েছে’ দাবি করে বরাবরই আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা বাস্তবতা অস্বীকার করে গেছেন। এমনকি এর জের ধরে তারা তড়িঘড়ি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করে। এর বাইরে দেশি-বিদেশি মহলের ইন্ধন রয়েছে বলেও নানাসময় অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, একদিকে যেমন সরকার এরমধ্যে প্রতিপক্ষের ইন্ধন খুজেছে, তেমনি আন্দোলনেও তাদের প্রতিপক্ষরাও নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে, অংশ নিয়েছে। ফলে আন্দোলন ব্যাপকতা পেয়েছে, সংঘর্ষ-সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। পরবর্তীতে সরকার আলোচনার কথা বললেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে এটা কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছাড়িয়ে জনমানুষের ক্ষোভের একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার ছেলে ও তার সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কোটা আন্দোলন যে সরকার উৎখাতের দিকে গড়াবে, সেটি তারা কেউ ধারণা করতে পারেননি।
শেখ হাসিনাকে ডুবিয়েছে ‘গ্যাং অব ফোর’: গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে টানা দেড় দশকের আওয়ামী রাজত্বের পতন ঘটেছে। ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় ও সরকার প্রধানের দেশত্যাগের খবরে গা-ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও। আত্মগোপনে থাকা এমন কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। আওয়ামী সরকারের পতন নিয়ে নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারা। তাদের বর্ণনায় সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে একটি অভ্যন্তরীণ স্বার্থগোষ্ঠীর কথা। যারা শেখ হাসিনার পতনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে মনে করছেন তারা। প্রতিবেদন অনুসারে, গ্যাং অব ফোরের সদস্যরা হলেন- শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তবে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, চারজনের এই দল তার (শেখ হাসিনা) পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এদের ওপর তার ছিল অন্ধবিশ্বাস। ফলে তার যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তাদের কারণে তিনি হারিয়েছেন। গোষ্ঠীটি তাকে বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি। আরেক নেতা বলেন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, পুলিশের নিষ্ঠুরতার কারণে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা বুঝছিলাম। বিএনপিকে নির্বাচনী আনা গেলে সেই ক্ষোভ হয়তো কিছুটা প্রশমিত হত। নির্বাচনে আমরাই আবার জিততে পারতাম এবং দলও ক্ষমতায় থাকত। কিন্তু তিনি আমাদের কথাও শোনেননি।
দিশেহারা আ’লীগ কর্মীরা: শেখ হাসিনা জীবন বাঁচাতে ভারতে চলে যাওয়ার পর দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও ছোট-বড় সকল নেতাদের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান-বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেওয়া, হামলা-ভাঙ্চুর ও লুটপাতের মতো ঘটনা ঘটে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে এদিক-ওদিক পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে যারা পালাতে পারেননি, তাদের কপালে জোটে নির্মম নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে মামলা। ফলে সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এক অর্থে উধাও হয়ে গেছেন। আত্মগোপনে থেকে সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, আগে বাঁচা-মরা, পরে রাজনীতি। এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন! অথচ দুই মাস আগেও রাজনীতিতে ছিল দলটির ছিল একচেটিয়া দাপট। এখন রাজপথে পুলিশ নেই, তবু একদল কিশোর-তরুণ ও যুবকের বাধায় ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতে পারলেন না কেউ। তবে প্রবল গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেয়া, আদালতে আইনজীবী পর্যন্ত নিয়োগ করতে না পারা, এমন সব ঘটনা এখন ঘটছে। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বাঁচব না কি মরব এর কোনো গ্যারান্টি নাই, আপনি আছেন দল নিয়ে। তিনি বলেন, গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও লুটপাট চালায় একদল মানুষ। জেলায় জেলায় একই ঘটনা ঘটেছে।
দুশ্চিন্তা ‘বেঁচে থাকা নিয়ে’: আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, নেত্রী এই দেশটাকে গড়েছেন, যাওয়ার আগে অবশ্যই জাতির উদ্দেশে এবং দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কিছু বলে যেতেন, হয়ত সময় পাননি। এখন দল কীভাবে চলবে এমন প্রশ্নে আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বাঁচব না কি মরব এর কোনো গ্যারান্টি নাই, আপনি আছেন দল নিয়ে। দেখেন না যেখানে আওয়ামী লীগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই হত্যা করে যাচ্ছে। দোয়া করেন যেন বেঁচে থাকি, তাহলে বহু কিছু করা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন দল নিয়ে নেই। আছে বাঁচা মরার লড়াই নিয়ে। আরেক নেতা বলেন, সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত, কেউ রেহাই পাচ্ছে না, যেখানে যাকে পাচ্ছে পিটিয়ে, কুপিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাঁচলে রাজনীতি, বাঁচার সুযোগ দেয় কিনা, সেটাই এখন বিষয়।
বেপরোয়া হামলা-লুটপাট: সরকার পতনের বিকালেই ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি কুতুব জাহাঙ্গীরের বাড়িতে হামলা হয়। তাকে রাস্তায় নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরের প্রতিবেশী ফখরুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ করে কয়েক শ’ লোকজন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করেন তাকে। তখন বাড়ির অন্য লোকজন বাড়ি থেকে বের হতে হতেই কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। পরে ডুপ্লেক্স বাড়টিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ৫ অগাস্ট দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শারিফুল ইসলাম শারিফ নদী পার হয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। তাকে মারধর করে গলায় রশি বেঁধে পানিতে চুবিয়ে দেওয়া হয়। কামরাঙ্গীর চর ঘাটের লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে তার খোঁজ পায়নি পরিবার। পরে অনেক দূরে তিনি ভেসে উঠেন। তিনদিন পর তার পরিবার এই কথা জানতে পারে। একই অবস্থা সারা দেশের জেলা থানা পৌরসভা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগসহ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও। ৫ অগাস্ট লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের বাসায় আগুন দেয়া হয় মিছিল নিয়ে এসে। বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর সেখান থেকে ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সরকার পতনের পর পর সারাদেশেই আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা শুরু হয়। আগুন লাগাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে একাধিক এলাকায়। সরকার পতনের পর পর সারাদেশেই আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা শুরু হয়। আগুন লাগাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে একাধিক এলাকায়। নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে আগুন দেয়ার পর সেই বাড়ি থেকে চার জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। সিলেটে সরকারি স্থাপনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, মৌলভীবাজার-২ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে গত নির্বাচনে নির্বাচিত রণজিত চন্দ্র সরকার, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন ও নগরভবনে হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের শ্বশুরবাড়িতেও আক্রমণ হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সহিংসতায় ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায় ৩৩ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আন্দোলনকারীরা সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। সরকারি ভবন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাসা-কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন হোটেল জাবীর ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এক বিদেশিসহ ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকনা এবং সদর উপজেলার বৈকারী গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের কারখানা ও গুদাম লুট হয়েছে। গ্রুপের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এই লুটপাটে তাদের কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রাজনৈতিক স্বার্থে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হওয়া হামলাকে ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই বলে মনে করে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। তারা বলছে, সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর রাজনৈতিক স্বার্থে হামলা হয়েছিল। কিছু সুযোগ সন্ধানীও এই হামলায় যোগ দিয়েছিল। গত শুক্রবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মঠ, মন্দির, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবেদন প্রকাশ; আসামিদের গ্রেফতার, শাস্তি বিধান, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও সংখ্যালঘু সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব পেশ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংখ্যালঘু সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তাদের জন্য জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন রাখতে হবে। সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে কোনো দলই হিন্দু সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকার পতনের পর বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তা সঠিক বলে মনে করে হিন্দু মহাজোট। তবে হিন্দু মহাজোট নিজেরাও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই হিসাব তুলে ধরে হিন্দু মহাজোটের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ৬ আগস্ট থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৩২টি সাধারণ হিন্দু পরিবার হামলার শিকার হয়েছে, যারা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। প্রায় এক হাজার পরিবার চাঁদাবাজির শিকার হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ৪৩টি অরক্ষিত মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ১৩২টি সাধারণ হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িকও না, আবার রাজনৈতিকও না। জমিজমা নিয়ে বিরোধ, পূর্বশত্রুতার জেরে এই সুযোগে হামলা করা হয়েছে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স