স্টাফ রিপোর্টার
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন হয়। সে উপলক্ষে দুই পর্বে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সরকার। এতে যোগ দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বাণিজ্যমেলার পুরাতন মাঠে। সমাবেশে অংশ নেন আওয়ামী লীগ ও এর সকল অঙ্গ সংগঠনের কয়েক লাখ নেতাকর্মী। এই সমাবেশে আসা রূপগঞ্জ উপজেলা যুব মহিলা লীগের ব্যানারে বর্তমান নেত্রীদের জায়গায় দেখা যায় সাবেকদের ছবি। বর্তমানদের পক্ষে ছিল না কোনো স্লোগানও। বিষয়টিকে রূপগঞ্জ উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি ফেরদৌসী আক্তার রিয়া সেদিন জানিয়েছিলেন, এটা তাদের ‘ভুল’। তৃণমূলের সেই ভুল বছর না ঘুরতেই রোষানলে রূপ নিয়েছে। যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রে এখন অভ্যন্তরীণ ক্রন্দন।
সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, যুব মহিলা লীগের এই অস্থিরতার কারণ সংগঠনের সাবেক দুই নেত্রী। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে তাদের দূরত্ব। সিনিয়র মেয়েরা তাদের কাছে গিয়ে কমফোর্ট ফিল করে না। কেন করে না, আমরা জানি না। তবে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী বলেন, অপু দি আর নাজমা আপার আলাদা সিন্ডিকেট আছে। তারা এখনো নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চান। দুই মহানগর তো তাদের হাতেই। সেন্ট্রাল কমিটির অনেকেই তাদের সঙ্গে প্রোগ্রাম করে। তবে বর্তমান কমিটির পদে থাকা ও পদপ্রত্যাশী একাধিক নেত্রী জানিয়েছেন, বিগত কমিটির সভাপতি নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিলের কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাবেক এই দুই নেত্রী এখনো সংগঠনে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চান। তাদের ‘মাই ম্যান’ হিসেবে পরিচিতদের দিয়ে সাংগঠনিক কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনের নেত্রীদের ভাষ্য সাবেক কমিটির দুই শীর্ষ নেত্রীর আস্থাভাজন ছিলেন বর্তমান ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেত্রীরা। তাদের মাধ্যমে বর্তমানে সংগঠনের নগরে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছেন নাজমা ও অপু উকিল। ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর যুব মহিলা লীগের সভাপতি হন আলেয়া সারোয়ার ডেইজি ও সাধারণ সম্পাদক হন সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী শারমিন সুলতানা লিলি। দেড় বছর পার হলেও ঢাকার দুই মহানগরে ‘চেইন অব কমান্ড’ ঠিক করতে ব্যর্থ এই দুই নেত্রী। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, নাজমা আক্তার ও অপু উকিল এখনো দুই নগর শাসন করছেন। চারজনই (ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) তাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের অযোগ্য নেতৃত্ব প্রমাণ করার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি সংগঠনের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক শামীমা রহমান কেন্দ্রীয় সভাপতিকে নিয়ে সমালোচনা তৈরি করেন। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপে ‘মিথ্যা তথ্য’ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে এই নেত্রীর বিরুদ্ধে। তবে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রীরা জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত সকল তথ্য প্রমাণ কেন্দ্রে জমা আছে। একই ধরনের অভিযোগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি তাহেরা খাতুন লুৎফার বিরুদ্ধে। অভিযোগ আমলে নিয়ে এরমধ্যে এই দুই নেত্রীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। গত ৫ মার্চ গঠনতন্ত্রের ২২ এর (ক) ধারা মোতাবেক সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা/কারণ দর্শাতে নির্দেশ প্রদান এই দুই নেত্রীকে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, গত ৪ মার্চ ২০২৪ তারিখে আপনি ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অফিসে ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণের বর্ধিত সভায় বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী অশালীন, অসৌজন্যমূলক, উচ্ছৃঙ্খল এবং অরাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করেন। যার সুস্পষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। সভাপতি-সেক্রেটারি আমাদের (গণমাধ্যমে প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) বলে গালি দেয়। গায়ে হাত তোলে। গত এক বছর দল থেকে কিছু না কিছু সহযোগিতা তো করছে। সেই সহযোগিতা আমরা পাইনি। মেয়েদের নিয়ে মিটিংয়ে যেতে দেরি হলে (গণমাধ্যমে প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) বলে বকা দেয়। এতে আরও বলা হয়, আপনার বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার ব্যাখ্যা আগামী ৬/৩/২০২৪ তারিখ থেকে ১০/৩/২০২৪ ইং তিন কর্মদিবসের মধ্যে আপনার উপযুক্ত লিখিত জবাব কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বরাবর প্রেরণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সংগঠনের নগর ও কেন্দ্রীয় নেত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। নিজেদের মধ্যের জটিলতা সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। যুব মহিলা লীগের সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজির সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তারা (মহানগরের নেত্রীরা) অসাংগঠনিকভাবে যে ধরনের কর্মকাণ্ড করছে সেটার জন্য আমরা তাদের চিঠি ইস্যু করেছি। বিগত আমাদের যে সব আন্দোলন, কর্মসূচি হলো, তাতে তারা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করেনি। অপরদিকে সাবেক যে দুইজন (যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল) তাদের সঙ্গে মহানগর যায়, যোগাযোগ করে। আমরা চেইন অব কমান্ড ঠিক করার জন্য এই চিঠি ইস্যু করেছি। সংগঠনে সাবেক নেত্রীদের প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগ সভাপতি বলেন, তারা ওয়ার্ড লেভেল থেকে শুরু করে মহানগর পর্যন্ত কাজটা করতে চাচ্ছে। তারা যুব মহিলা লীগের নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। কী সমস্যা জানি না। আলেয়া সারোয়ার ডেইজি বলেন, চারজনই (ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) তাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের অযোগ্য নেতৃত্ব প্রমাণ করার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ জানিয়ে ডেইজি বলেন, কেন আমি অমুক ইন্টারভিউতে অপু উকিলের নাম বলিনি? মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক শামীমা রহমান আমাকে ফোন করে এটা বলে। বিগত কমিটির সভাপতি নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিলের কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাবেক এই দুই নেত্রী এখনো সংগঠনে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চান। তাদের ‘মাই ম্যান’ হিসেবে পরিচিতদের দিয়ে সাংগঠনিক কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, যুব মহিলা লীগের বর্তমান দুই শীর্ষ নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলেয়া সারোয়ার ডেইজি বলেন, হ্যাঁ, আমরা সময় চেয়েছি। সব বিষয়েই আলাপ-আলোচনা করতে চাই। সংগঠনের সমস্যার বিষয়গুলোও আমরা তুলে ধরবো। নগরের নেত্রীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন যুব মহিলা লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক শামীমা রহমান। সাবেক কমিটির নির্দেশনা মেনে চলার অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি। উল্টো শামিমা অভিযোগ করেন যুব মহিলা লীগের বর্তমান সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজি তাদের ‘গায়ে হাত তোলেন’। তিনি বলেন, সভাপতি-সেক্রেটারি আমাদের (গণমাধ্যমে প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) বলে গালি দেয়। গায়ে হাত তোলে। গত এক বছর দল থেকে কিছু না কিছু সহযোগিতা তো করছে। সেই সহযোগিতা আমরা পাইনি। মেয়েদের নিয়ে মিটিংয়ে যেতে দেরি হলে (গণমাধ্যমে প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) বলে বকা দেয়। শামীমা দাবি করেন বাংলাদেশে কোনো নেত্রী আছে, লিলি আপা, লিলি আপা, আমরা এটা কেন বললাম না। এটার জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হইছে। এ বিষয়ে জানতে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। শামীমা অভিযোগ করে বলেন, অধ্যাপিকা অপু উকিলকে আমরা সালাম দিতে পারবো না। নাজমা আপাকে সালাম দিতে পারবো না। দাওয়াত দিতে পারবো না। কেন পারবো না? এসব একটা কথা? যুব মহিলা লীগের সাবেক নেত্রীদের বিষয়ে বর্তমানদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে সংগঠনটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিলকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি কল ধরেননি। পাওয়া যায় সংগঠনের সাবেক সভাপতি নাজমা আক্তারকে। সংগঠনে না থাকলেও সংরক্ষিত আসনের বর্তমান এই সংসদ সদস্যের ভাষ্যমতে— তিনি যুব মহিলা লীগের বর্তমান কমিটির সব কিছুরই খোঁজ রাখেন। নাজমা আক্তার বলেন, বিষয়টা (সংগঠনে নিজেদের হস্তক্ষেপ ও মহানগরকে নিজেদের কথা পরিচালিত করা) একেবারেই সত্য না। এটা কখনোই না। তারা (বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) যদি দীর্ঘদিনের মেয়েদের ধরে রাখতে না পারে, এটা যদি অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে তো তা পারবে না। তিনি বলেন, তাদের (কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দুই মহানগরের) মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। এটা মিটে যাবে। যুব মহিলা লীগের অভ্যন্তরীণ ক্রন্দন গণভবন পর্যন্ত গড়িয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমা আক্তার বলেন, আপনি তো অনেক কিছুই জানেন। বর্তমান সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজি ও সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলির বিষয়ে তিনি বলেন, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে তাদের দূরত্ব। সিনিয়র মেয়েরা তাদের কাছে গিয়ে কমফোর্ট ফিল করে না। কেন করে না, আমরা জানি না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
