ঢাকা , শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ , ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
গাজায় ইসরায়েলি নির্মম গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ নড়াইলে সৌদি প্রবাসী হত্যা হামলা-ভাঙচুরের পর পুরুষশূন্য গ্রাম প্রেস সচিবের মন্তব্যকে ‘অযাচিত’ বলছে ভারত রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ‘কাফন মিছিল’ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা অনৈক্যের সুর রাজনীতিতে বাড়ছে অবিশ্বাস দলিতদের পরিবর্তনে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ- আনু মুহাম্মদ মালয়েশিয়ায় অভিযানে ১৬৫ বাংলাদেশি আটক জাবির থিসিসের ফলাফল বিপর্যয়ের অভিযোগ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ জন হাসপাতালে ভর্তি চীনের অর্থায়নে পঞ্চগড়ে হাসপাতাল নির্মাণের দাবি যশোরে আগুনে পুড়লো ফার্মের ৪৪ হাজার মুরগি ঈদের পর থেকে বাজারে সবজির দাম বাড়তি চার মাসের সন্তানকে বিক্রি করে মোবাইল কেনেন মা! মানহীন কিন্ডারগার্টেনে ধ্বংস শিশুর ভবিষ্যৎ টিসিবির জন্য কেনা হবে ৫৪২ কোটি টাকার তেল সৌদি আরব-মরক্কো থেকে ৪৬৬ কোটি টাকার সার কিনবে সরকার জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ ৫ জন দুদকের হাতে গ্রেফতার টিপাইমুখ বাঁধ দেয়ার প্রতিবাদ করায় ইলিয়াস আলী গুম হন- রিজভী কনটেইনারবাহী জাহাজ চলবে দুই বন্দরে
দেশের ১৩ জেলা আক্রান্ত * ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি * চার জেলায় ৬ জনের মৃত্যু * ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন চলাচল বন্ধ * রাঙামাটির ২০ স্পটে পাহাড় ধস * বিস্তীর্ণ জনপদে পানিবন্দি মানুষের জীবন বাঁচানো মুখ্য

ভয়ানক রূপে বন্যা

  • আপলোড সময় : ২২-০৮-২০২৪ ১০:৫৪:০৫ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২২-০৮-২০২৪ ১০:৫৪:০৫ অপরাহ্ন
ভয়ানক রূপে বন্যা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে কুমিল্লা। উজান থেকে নেমে আসা নদীর পানিতে ক্রমেই ফুঁসে উঠেছে গোমতী নদী। সেই সঙ্গে অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট পানির তোড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে -জনতা
শাহিদুর রহমান শাহিদ
ভয়াবহ বন্যা দেশের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বন্যায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ফেনী। এ জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদে পানিবন্দি মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রামের তিনটি উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি বাড়তে থাকায় খাগড়াছড়ির আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও বন্যায় ডুবে গেছে। মৌলভীবাজার জেলার জেলা সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানে ২০টি স্পটে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে।
কুমিল্লায় বন্যা ও বৃষ্টির মধ্যে একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, একজনের মাথায় গাছ পড়ে এবং একজন পানিতে তলিয়ে মারা গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও ফেনীতে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। তিনি জানান, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী-নৌবাহিনী বিজিবি উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
চলমান বন্যায় দেশের ৮ জেলার ৫০ উপজেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪।
ফেনীতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় ফলে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৭ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন, কিছুক্ষণ পরপর সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।
উজানে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভারত এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে, বলেছে বাঁধের মুখ তারা খোলেনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। এতে করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, ফেনী, মুহুরী কহুয়া, সিলোনীয়া, মাইনী ও হালদা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। ৭ হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
দুর্গতদের জন্য নগদ ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে জানিয়ে কে এম আলী রেজা বলেন, ১৩ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল ও ১১ হাজার বস্তা শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সকল জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে।
তিনি জানান, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে, তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও, সহায়তার জন্য ফোন করা যাবে ০১৩১৮২৩৪৫৬০ নম্বরে।
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সারাদেশে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিতে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলে বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত আজ শুক্রবার বিকেলের দিকে কমতে পারে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, খাগড়াছড়িসহ পাহাড়ি অঞ্চলে আগামী ২ দিনের বেশি ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বৃষ্টিপাত কমে আসছে। আগামী ২৬ তারিখ থেকে সারাদেশে বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে।
বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থার বরাতে সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরে উন্নতি হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও কাছাকাছি উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা নদীর নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর পানি সমতলে কমে যেতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপ ও অবিরাম বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী।
জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদে পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।
বন্যাকবলিতরা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি কেউ। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে।
বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ারসার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন।
তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ফেনীর মুহুরী নদীর পানি।
ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যা কবলিত।
এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তা-ঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় বানের পানি মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালও ছুঁয়েছে।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হান মেহেবুব বলেন, তিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে। এছাড়া ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়া উপজেলার অনেক এলাকাও বন্যা কবলিত।
তিন উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, স্থানীয় লোকজন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে।
গত বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার কথা জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
এছাড়া ফেনীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উঁচু ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, ফেনী শহরেও পানি জমেছে। বেশিরভাগ উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ নেই।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে লোকালয় রক্ষা করতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মুহুরী রেগুলেটরের (জলকপাট) ৪০টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, জুলাই মাসের শুরুতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি বেড়ে ১৫ স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। সে সব স্থানে জোড়াতালির মেরামতের পর চলতি মাসের শুরুতে বাঁধের আরও ১১ স্থানে ভেঙে গিয়ে প্লাবিত হয় ১শ’ টির বেশি গ্রাম।
গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কয়েশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফেনীর জেলা প্রশাসক সেলিনা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, বন্যা কবলিতদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি কাজ করছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও মাঠে আছে।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া ফেনীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুকী আজম।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন শেষে বিকাল ৩টার দিকে ফেনীর পথে রওনা হওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
ফারুকী আজম বলেন, এখনই বন্যা পরিস্থিতি দেখতে সড়কপথে ফেনী যাচ্ছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর।
গত বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত আখাউড়া উপজেলায় নতুন করে আরও অন্তত পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৪০টি গ্রামের হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর দিনযাপন করছেন।
এছাড়া বন্যার কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজালা পারভীন রুহি জানান, গত বুধবার দুপুরে উপজেলার বীরচন্দ্রপুর গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যু হয়েছে।
ঘরে পানি ঢুকে পড়লে সুবর্ণা বের হতে গিয়ে পা পিছলে একটি গর্তে পড়ে যান। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজালা পারভীন রুহি বলেন, গত বুধবার রাতে পানি আরও বাড়ায় নতুন করে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুর্গতদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
এছাড়া যারা ঝুঁকি নিয়ে এখনো বাড়িতে অবস্থান করছেন- তাদেরকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
রাঙ্গামাটিতে টানা বর্ষণে জেলার বিভিন্ন স্থানে ২০টি স্পটে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের ঘাগড়ার কলাবাগান এলাকায় পাহাড়ধসে প্রায় দুই ঘণ্টা সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। পরবর্তীতে সড়ক বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সড়ক থেকে মাটি সরিয়ে যান চলাচল সচল করে।
তবে মহালছড়ি এলাকায় সড়কের ওপর পানি থাকায় বন্ধ রয়েছে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি আন্তঃজেলা যান চলাচল। জেলার কাউখালী উপজেলার ইছামতি খাল ও কাউখালী খালে পানি বেড়ে ডুবে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২০টি ঘর।
এদিকে জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে বেড়াতে আসা আড়াইশ পর্যটক সাজেক ত্যাগ করতে পারেননি। কাচালং নদীর পানি বেড়ে খাগড়াছড়ি-সাজেকের একাধিক স্থানে সড়ক ডুবে যাওয়ায় পর্যটকরা গতকাল থেকে আটকা পড়েছেন।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরিন আক্তার বলেন, আপাতত সাজেকে আটকাপড়া পর্যটকদের বিকল্প উপায়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আজও তাদের সাজেকে অবস্থান করতে হবে। উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হলেও রাতের বৃষ্টিতে আরও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন জানান, জেলায় ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও কোথাও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বাঘাইছড়িতে বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় প্রায় দুই হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি সদরে পাহাড়ধসে ঝুঁকিতে আছে ১৩৬৬ মানুষ। প্রাণহানি এড়াতে ৭৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে।
মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
জেলা সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি বাড়তে থাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মৌলভীবাজারের মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে রাজনগর উপজেলার নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েকটি ইউনিয়নে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে রাজনগর উপজেলার কদমহাটা এলাকায় মনু নদীর বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। বন্যার ঝুঁকিতে থাকা পৌর শহরে মাইকিং করে সতর্ক করছে জেলা প্রশাসন।
যেকোনো সময় ভাঙতে পারে শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ। তাই শহরের দোকানগুলোর পণ্য সামগ্রী নিরাপদ স্থানে নিতে বলা হচ্ছে। একইসঙ্গে যারা বাসাবাড়ির নিচ তলায় অবস্থান করছেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে ওঠার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে।
প্লাবিত হয়ে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে বন্যা। এরইমধ্যে পানিবন্দি হয়ে আছে কয়েক লাখ মানুষ।
এদিকে টানা বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি নদ-নদীতে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সকাল ৯টায় জুড়ী নদ বিপদসীমার প্রায় ১৯০ সেন্টিমিটার ওপর, ধলাই নদ বিপদদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ও মনু নদীর চাঁদনীঘাটে ১১৫ সেন্টিমিটার ও রেলওয়ে ব্রিজে ১০৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়াও মৌলভীবাজারের শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চারদিনের দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে হাওর ও নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাড়িঘরও প্লাবিত হচ্ছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, ভয়াবহভাবে পানি বাড়ছে। নদ-নদীর বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। আমরা জিও ব্যাগ ফেলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। নদ-নদীর বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও এলাকায় মনু নদে ভাঙন দেখা দিয়েছে। রাজনগর এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নদ-নদীর বাঁধ উপচে পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে কতটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে তা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি বাড়ছে। বর্তমানে পানি বিপদসীমার ১৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অপরদিকে শহর রক্ষা বাঁধ হুমকিতে পড়েছে। সামান্য পানি বাড়লেই বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করবে।
তবে শহরতলির জালালাবাদ গ্রামের পাশে খোয়াই নদীর বাঁধের ভাঙন দিয়ে প্রবল বেগে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। এভাবে হাওরে পানি প্রবেশ করতে থাকলে দ্রুত বাড়িঘরেও ঢুকতে পারে পানি।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, খোয়াই নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় খোয়াই নদীর জেলা শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৯২ সেন্টিমিটার এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বাল্লা পয়েন্টে ২৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছি।
খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ভারত সবগুলো গেট খুলে দেয়ায় হবিগঞ্জে খোয়াই, কুশিয়ারা, কালনীসহ সবগুলো নদীর পানি বাড়ছে।
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ঈদগাঁও ও রামু উপজেলা প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আকস্মিক এই বন্যায় রামুতে অন্তত একজনের মৃত্যু ও দুইজন নিখোঁজ হয়েছেন।
মারা যাওয়া ব্যক্তি হলেন ঈদগাঁও ইউনিয়নের বাদ্যপাড়ার কোচিন রাখাইন (৫০)। আর নিখোঁজ দুইজন হলেন—রামুর পূর্বজুমছড়ি গ্রামের ছায়েদ হোসেনের ছেলে আমজাদ হোসেন (২২) ও সালেহ আহমদের ছেলে রবিউল আলম (৩৫)।
বন্যায় পানিতে ভেসে গিয়ে আমজাদ ও রবিউলের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশিম। আর কোচিনের মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছেন রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশিদুল ইসলাম।
তিনি আরও জানান, বন্যায় রামুতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ঈদগাঁওয়ের ইউএনও সুবল চাকমা জানান, ওই উপজেলায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বরে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেটের সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি থাকলেও কুশিয়ারা নদীর চারটি পয়েন্টে ইতোমধ্যে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আবারও বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সিলেটের কুশিয়ারা নদীর ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের তথ্য মতে, সকাল ৯টায় সিলেটের কুশিয়ারা নদীর জকিগঞ্জ অমলসিদ পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার, বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলায় ৬ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৭১ সেন্টিমিটার, শেরপুর পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল।
দুপুর ১২টায় একই নদীর পানি অমলসীদ পয়েন্টে ২৪ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে এক সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ সেন্টিমিটার ও শেরপুরে তিন সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়াও সকাল ৯টায় কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ১ দশমিক ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।
আর দুপুর ১২টার তথ্য অনুযায়ী, শূন্য দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ও ১ দশমিক ০১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় গত বুধবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।
এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু আগেই এই জেলায় কয়েকবার বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তাই পূর্বের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সার্বক্ষণিক তদারকি করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। প্রতি ঘণ্টায় ১০-১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে নদীর পানি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শহরের তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে পানি। আতঙ্কিত মানুষ বাঁধ পাহারা দিচ্ছেন। যদি কোনোভাবে বাঁধ ভেঙে যায় তবে তলিয়ে যাবে কুমিল্লা শহর। একপাশে শহর আরেক পাশে নদী, মাঝখানে বাঁধ।
অপরদিকে নদীর কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কামারখলা এলাকায় বাঁধ ফুটো হয়ে যায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে। স্থানীয়রা বস্তা দিয়ে সেই ফুটো বন্ধ করে দেয়। পরে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান ওয়ালিউজ্জামান বলেন, আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাঁধ সুরক্ষিত আছে। পানির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। 
এদিকে কুমিল্লায় বন্যা ও বৃষ্টির মধ্যে একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, একজনের মাথায় গাছ পড়ে এবং একজন পানিতে তলিয়ে মারা গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গত বুধবার বিভিন্ন সময়ে ওই তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
মৃতরা হলেন-নাঙ্গলকোট পৌরসভার দাউদপুর এলাকার বাসিন্দা কেরামত আলী (৪৫), নগরীর ছোটরা এলাকার রাফি (১৫) ও চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার সোনাকাটিয়া গ্রামের কানু মিয়ার ছেলে শাহাদাত হোসেন (৩৪)।
টানা বৃষ্টি ও বন্যায় চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড ও মীরসরাই উপজেলায় ২০ হাজারের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
নদী ভাঙন ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফটিকছড়ি উপজেলা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে ফটিকছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।
টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে হালদা নদীর পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। পাশাপাশি নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের কারণে পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, উপজেলার পৌরসভা ছাড়া বাকি সব ইউনিয়ন পানির নিচে। অন্তত দেড় লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বন্যা দুর্গতদের আশ্রয় দিতে উপজেলায় ৪৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে দুই হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান ইউএনও।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বাগানবাজার এলাকায় বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ছে। এর সঙ্গে টানা বর্ষণের কারণে পানি প্রবাহ বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে খাগড়াছড়ির বানের পানিও নেমে আসছে, যার কারণে হালদা নদীর পানি বেড়েছে। তাতে করে তলিয়েছে ফটিকছড়ি উপজেলা সদরের বিভিন্ন অংশ, পাইন্দং, সুন্দরপুর, হারুয়ালছড়ি, ভূজপুর, নারায়ন হাট, দাঁতমারা, বাগান বাজার, সমিতির হাট, ধর্মপুর, নানুপুর, লেলাং, রোসাংগিরিসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ন হাট পয়েন্টে হালদা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বুধবার ১০৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল।
এছাড়া ফেনী নদীর পানি বিপদসীমার তিন মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সোহাগ তালুকদার বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গত তিন দিন ধরে হালদা নদীর বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত বুধবার রাত থেকে কিছুটা উন্নতি ঘটলেও ভোর থেকে টানা বৃষ্টিতে আবার পানি বাড়ছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত পানির কারণে ফটিকছড়ি অংশে হালদা নদীর ২২টি পয়েন্টে নদী ভাঙন হয়েছে। পাশাপাশি অনেক স্থানে বাঁধের উপরে পানি প্রবেশ করছে।
আমরা সিনথেটিক ব্যাগ বসিয়ে পৌরসভা এলাকায় পানি প্রবেশ কিছুটা কমিয়েছি, তবে ইউনিয়নগুলোতে পানি প্রবেশ করছে।
চট্টগ্রামে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৪১ দশমিক ৮ মিলিমিটার। এছাড়া সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে তিন ঘণ্টায় ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় চট্টগ্রামের সঙ্গে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ আছে বলে জানান হাইওয়ে পুলিশ নাজিরহাট ফাঁড়ির পরিদর্শক মফিজ উদ্দিন।
তিনি জানান, সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠে যাওয়ায় বেলা ১২টার দিক থেকে ছোট ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৭ কিলোমিটার এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। তাতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন, কিছুক্ষণ পরপর সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।
কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের এসপি খায়রুল আলম জানান, গত বুধবার গভীর রাত থেকেই মহাসড়ক পানিতে প্লাবিত হতে শুরু করে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কুমিল্লার নবগ্রাম রাস্তার মাথা থেকে চৌদ্দগ্রাম বাজার পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়ক তলিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা খায়রুল আলম বলেন, মহাসড়কের ফেনী ও চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন এলাকা বুধবার গভীর রাত থেকেই প্লাবিত হতে শুরু করে। সময় যত যাচ্ছে, অবস্থা ততই বেগতিক হচ্ছে।
বর্তমানে যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে, সেসব এলাকায় যানবাহন চলাচল করছে ধীরগতিতে। আমাদের সংশ্লিষ্ট হাইওয়ে থানা পুলিশের পাশাপাশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কুমিল্লা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফটিকছড়ি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের তিন হাজার ১৭৫ পরিবার, মীরসরাই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১২ হাজার ও সীতাকুণ্ডের ছয়টি ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় মোট ৫০ টন চাল ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ২৩২টি আশ্রয় কেন্দ্র ও ১২৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে সার্বিক জলাবদ্ধতার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বর্তমানে জেলার পাঁচটি উপজেলায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। চার দিন ধরে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়ে আছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও জোয়ারে মেঘনা নদীসহ জেলার সব কটি খালের পানি বাড়ছে বলে জানিয়েছে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে কয়েক হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে আমন ধানের ক্ষেতসহ শত শত হেক্টর জমি শাকসবজি।
রামগতি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, গত চার দিনে লক্ষ্মীপুরে ৩১২ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। নদীতে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত ছিল। এখন তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দু’এক দিনের মধ্যে আবহাওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এত পানি আগে কখনো দেখা যায়নি। এতে নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে উপজেলা প্রশাসন সাধারণ মানুষদের নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন খালের বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। খাল-নালা পরিষ্কারের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বন্যার্তদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানির কারণে দেশের নয়টি জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। পানিতে ঢুবেছে মহাসড়ক ও রেললাইন। ফলে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে ওই দুই পথে ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়।
এতে বলা হয়, আকস্মিক বন্যায় সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক জায়গায় রেলপথ ডুবে গেছে। এমন অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় সব আন্তঃনগর, কমিউটার ও মেইল ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হলো। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ আদেশ বলবৎ থাকবে।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য