টানা চার মেয়াদের আট মাসের মাথায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের। মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (প্রথম শহীদ) নিহতের ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের মুখে পাশ^বর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর শিক্ষার্থীদের দাবিরমুখে ৮আগস্ট রাতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এদিন আরও ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে ১৩ জন উপদেষ্টাকে বঙ্গভবন দরবার হলে শপথ বাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সর্বশেষ গতকাল রোববার সরকারের ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের আরও দুই উপদেষ্টা আজ শপথ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের দফতর বন্টন করার মধ্যদিয়ে জণগনের প্রত্যাশাপূরনে কাজ শুরু করেছেন। দিচ্ছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও। তবে এই সরকারের উপদেষ্টারা কতদিন থাকবেন তার কোনো মেয়াদ নেই বলে জানিয়েছেন অনেকে। তারা বলছেন, যতদিন প্রয়োজন, দেশ ও দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণের মধ্যদিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করে বিদায় নিতে চান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাস। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। এ সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একদফা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা ৮ আগস্ট শপথ নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের আলোকে এই সরকারের বৈধতা দিয়েছেন। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে মতামত দেন সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বলা বলা আছে যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে আইনের এইরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্ব সম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন। কিন্তু এই মতামতে সরকারের কোনো সময় সীমা নেই। সময় সীমা নিয়ে এরই মধ্যে সরকারের এক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, মেয়াদের বিষয়ে এখন আলোচনা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না। আপনি কী রিফর্ম চান সেটা না বুঝে তো মেয়াদের কথা বলতে পারব না। আর যদি রিফর্ম না চান তাহলে আলাদা কথা। মেয়াদ নিয়ে অস্থির হওয়ার কিছু নাই। আমরা সবাই যেন একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য যাত্রা শুরু করতে পারি, সেটার প্রস্তুতির জন্যই তো এই সরকার। সেই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন শুধু সেটুকু সময়ই আমরা নেব। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের দিকেই আমাদের যাত্রা। আরেকজন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, এ (মেয়াদের) বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের যেহেতু গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে গঠিত একটি সরকার এবং অনেক সংস্কারের কথা আমরা বলেছি, সেগুলো আমাদের করতে হবে। তিনি বলেন, সেটা যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার পর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এই সরকারের মেয়াদ শেষ করব। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তিন দিন দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। সর্বোচ্চ আদালত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু সংবিধানে এই সরকার ব্যবস্থা নেই। আবার সংবিধান স্থগিতও করা হয়নি। তাই আমাদের এই সরকারের বৈধতা বিবেচনা করতে হবে ডকট্রিন অব নেসেসিটির ওপর। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে তা বিবেচনায় নিতে হবে। মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ না। মেয়াদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুশাসন, আইনের শাসন, রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছুই ভেঙে পড়েছে। আর এটা সংস্কারের কাজ তিন বা ছয় মাসের কাজ নয়। নির্বাচন দিতে হলে নির্বাচন কমিশনের যে সংস্কার সেটা করতেও তো সময় লাগবে। আসলে এই সরকারের উদ্দেশ্য শুধু নির্বাচন নয়। এর মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্র সংস্কার। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই সরকারকে গ্রহণযোগ্য সময় দিতে হবে। তার কথায়, রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় ওই সংস্কারের সুফল নাও পাওয়া যেতে পারে। একইসুরে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম। তিনি বলেন, এটাকে কেয়ারটেকার সরকার বলা হচ্ছে না। সেটা বলা হলে মানুষের মনে তিন মাস মেয়াদের ধারণা হবে। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাস। কিন্তু এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ফখরুদ্দিনের সেনা সমর্থিত সরকার ছিল দুই বছর। আর এই সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হয়েছে। দেশের মানুষের একটি আকক্সক্ষা আছে তাদের কাছে। তাই সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার ওপর এই সরকারের মেয়াদ নির্ভর করছে। তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা হলো রেগুলার সরকারের পরিবর্তে একটি সরকার। এই সরকারকে সংবিধানের আলোকে দেখার দরকার নাই। মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষের ইচ্ছাই বড় আইন বা সংবিধান। যদি অভ্যুত্থান না হতো তাহলে কি সুপ্রিম কোর্ট এই সরকারের পক্ষে অপিনিয়ন দিত? আসলে দেশের মানুষের ইচ্ছাই বড় কথা।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কত হবে সেই আইনগত দিক আমি বলতে পারব না। তবে এই সরকার করা হয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে, রাষ্ট্র কাঠামো ঢেলে সাজানোর জন্য। আর রাষ্ট্র কাঠামো ঢেলে সাজানোর যে কর্মপরিধি তা কিন্তু স্বল্প মেয়াদে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন, তবে আমি মনে করি তারা যদি দেশবাসীর কাছে তাদের কাজের একটি রূপরেখা প্রকাশ করেন, সংস্কারের একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন, সেখানে যদি একটি টাইম ম্যানেজমেন্ট থাকে তাহলে ভালো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন হাসিব জামান বলেন, আসলে আমরা সরকার পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি না। আমরা রাষ্ট্রের সংস্কার করতে চাই। রাষ্ট্রসংস্কার শেষ হলে তারপর নির্বাচন হবে। সেটা যদি এক বছরে সম্ভব হয় তাহলে তাই হবে। তবে এর জন্য কত সময় লাগবে তা নিয়ে আমরা এখনো আলোচনা শুরু করিনি। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দিয়েছি তাতে তিন থেকে ছয় বছর সময়ের কথা বলেছি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে এ রকম সময়ই লাগবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

অন্তর্বর্তী সরকার : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতদিন চাইবে থাকতে পারবে
সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই
- আপলোড সময় : ১২-০৮-২০২৪ ১২:২২:২৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১২-০৮-২০২৪ ১২:২৭:৩৯ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ