জাহাঙ্গীর খান বাবু
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দেশের অর্থনীতিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্লথগতির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে দেশের রাজস্ব আহরণে। যার প্রমাণ সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি। সরাসরি প্রভাব রাজস্ব আহরণে পড়বে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েকদিন ধরে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রায় স্থবির ছিল পুরো দেশ। কারফিউ জারির পর থেকে কল-কারখানা চালু হয়েছে। ঘুরতে শুরু করেছে অর্থনীতির চাকা। তবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোদমে চালু না হলে রাজস্ব আহরণ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ভ্যাট আহরণে। এরইমধ্যে রাজস্ব আহরণের গতি শ্লথ হয়ে গেছে। দোকানপাটে বেচাকেনা কমে যাওয়া, কল-কারখানা পুরোপুরি সচল না হওয়ার প্রভাব পড়বে ভ্যাটে। আর ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় কমেছে শুল্ক আদায়ও। যার কারণে বড় ধরনের ঘাটতি নিয়ে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরেও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে টানা দশ দিন বন্ধ ছিল মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা। প্রায় পাঁচ দিন পর সীমিত আকারে চালু হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এই পাঁচ দিনে আমদানি-রফতানি থেকে শুরু করে রাজস্ব সংক্রান্ত সব কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারনেটের কারণে এই সময়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ই-কমার্স ব্যবসাও। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হওয়ায় রাজস্ব আহরণও স্থবির হয়ে যায়। অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে রাজস্ব আসবে কীভাবে। আগে অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে। এরইমধ্যে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে যারা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসা করতেন, তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এছাড়া অর্থনীতি স্থবির থাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। এসব খাতে রাজস্ব আহরণে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অর্থনীতি সচল থাকাকালীনও এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়, সেখানে এ পরিস্থিতিতে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব আয় বাড়ানোর চাপ রয়েছে। যার কারণে ২০২৪-২৫ নতুন অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জর মুখে পড়বে বলেও জানিয়েছেন খোদ এনবিআর কর্মকর্তারাই। অর্থনীতি যতটা সচল থাকবে, রাজস্ব আদায় ততোটা বাড়বে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এলে রাজস্ব আহরণ কমে যাবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এসব ক্ষেত্রে ভ্যাটের প্রভাব বেশি। তবে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে আগামী মাসের ভ্যাট আদায়ে। এছাড়া শুল্ক খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ সিংহভাগ শুল্ক আসে আমদানি খাত থেকে। আমদানি কমলে শুল্ক আদায় কমবে। আর সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে রাজস্ব আহরণে গতি ফিরবে বলে আশা করা যায়।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৭ হাজার ৪৩৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা কম রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যদিও বকেয়া রাজস্ব আহরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগে লক্ষ্যমাত্রার ৯৩.৩১ শতাংশ আদায় হয়েছিল। তারপরও বড় ঘাটতি এড়াতে পারিনি প্রতিষ্ঠানটি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাটা এখন তাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। তার ওপর দুশ্চিন্তার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, জুলাই মাসের শেষের এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলমান স্থবিরতায় দিনে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির ক্ষতি হয়ত টাকার অঙ্কে মাপা যায়, কিন্তু দেশের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মাপার কোনো বাটখারা নেই।
অন্যদিকে ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) মনে করছে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ফলে দেশের অর্থনীতিতে ১০ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। আর ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার কারণে ১০ দিনে ই-কমার্স খাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এত এত লোকসানের মধ্যে দেশের রাজস্ব আহরণ কীভাবে আসবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন বলে মনে করছেন এনবিআরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এনবিআর আয়কর ও কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, দেশই যেখানে স্থবির ও অস্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে রাজস্ব আদায়ের সুযোগ কোথায়। অর্থনীতির চাকা চলমান না থাকলে অর্থনীতির চলকগুলো কাজ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর দেশ স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক অবস্থায় না ফিরলে যেকোনো কৌশল কিংবা এনফোর্সমেন্ট উদ্যোগ কাজে আসবে না। এই মুহূর্তেও যদি সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়, নেতিবাচক প্রভাব থাকবে আরও বেশ কয়েক মাস। শুধু জুলাই মাসেই প্রত্যাশার তুলনায় রাজস্ব আদায় কমবে অন্তত ৪০-৬০ শতাংশ। বর্তমানে ধৈর্য ধারণ করা ও সীমিত পরিসরে যতটুকু কাজ করা যায়, আপাতত করণীয় এটাই। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা জিডিপির ৯.৭ শতাংশ। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য উৎস হতে ৬১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আয়কর, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর থেকে আসবে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, ভ্যাট থেকে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি, সম্পূরক শুল্ক ৬৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ৪৯ হাজার ৪৬৪ কোটি, রফতানি শুল্ক ৭০ কোটি, ৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও অন্যান্য কর থেকে আসবে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলমান অস্থির পরিবেশে এনবিআরের কী করণীয় থাকতে পারে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, পুরো অর্থনীতি এমনিতেই নেতিবাচক ছিল, আরও নেতিবাচক হয়ে গেল। এর পেছনে দুর্নীতিবাজ চক্রেরও হাত থাকতে পারে। তবে কাউকে দোষ দেয়া বা দায়ী করার চেয়েও বড় কথা হলো সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। এই মুহূর্তে এনবিআরের তেমন কিছু করার নেই। তিনি বলেন, যেটা করতে পারে সেটা হলো যেসব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে সেটা আদায়ের প্রচেষ্টা বাড়ানো। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে, তাদের বিষয়ে মনিটরিং করতে পারে। এনবিআর চাইলে তারা ব্যাংক ও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জানতে চাইতে পারে টাকাগুলো কোথায় কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে। ওই ফাইলগুলো ভালো করে দেখা উচিত। এটা দেখার আইনি দায়িত্ব তাদের রয়েছে। দুদকেরও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চলমান কার্যক্রম ভালো করে চালিয়ে যাওয়া উচিত।
করোনা মহামারির সময়ে সরকারি সাহায্য হিসেবে ৩০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছায়নি উল্লেখ করে আবদুল মজিদ বলেন, দেশের যেকোনো দুর্যোগের সময়ে সরকারি সহায়তা সুবিধা বড় বড় ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময়ও একই চিত্র দেখা গেছে। এবারও হয়ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কথা বিবেচনায় সরকারি সহায়তা আসবে। আমার কথা হলো ক্ষতি কিংবা সহায়তা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু ঋণ নেয়ার নামে যারা আত্মসাৎ করেছে, তাদের বিষয়ে কি করা হয়েছে? ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কি টাকা ফেরত দিয়েছে? এ বিষয়ে অন্তত এনবিআর চিঠি দিয়ে জানতে চাইতে পারে টাকাগুলো কোথায় গেল? আমার মতে ঋণ খেলাপিদের ধরে সুশাসনের আওতায় আনা প্রয়োজন। সুশাসনের বিকল্প নেই।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
![](https://dainikjanata.net/public/ads/65fd544197946.png)
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্থবির দেশের অর্থনীতি * অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি * জুলাই মাসে রাজস্ব আদায় কম ৪০-৬০ শতাংশ * স্থবিরতায় দিনে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা
চ্যালেঞ্জের মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
![চ্যালেঞ্জের মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চ্যালেঞ্জের মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড](https://dainikjanata.net/public/postimages/66ad31a220786.jpg)
![](https://dainikjanata.net/public/ads/65fd544197946.png)
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ