আগামীতে আর কোনোভাবেই বিএনপি-জামায়াত কিংবা নৈরাজ্য-সহিংসতাকারীদের মাঠ ছেড়ে দিবে না আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া নৈরাজ্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনগুলোতে মাঠে থাকবে দলটি। চলমান কারফিউ উঠে যাওয়ার পর দুষ্কৃতকারীরা মাঠে নামলে কঠোর হাতে দমন করবে টানা চার মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গত সাতদিন ধরে দেশজুড়ে চলছে কারফিউ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী।
সরেজমিনে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (১৮জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা করা হয়। এদিন বেলা ১২টায় ৬০ থেকে ৭০ জনের একঝাঁক তরুণ হামলার চেষ্টা করে ক্ষমতাসীনদের কার্যালয়ে। তবে কার্যালয়ের সামনে থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের প্রতিহত করেন। এরপরও দিনভর আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলার আশঙ্কা ছিলো। যদিও হামলা হয়নি। তবে সেদিন বিকেলে একচেটিয়া হামলা হয়েছে নগরীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড় থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের চারটি কার্যালয় ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। এছাড়াও রাজধানীতে আওয়ামী লীগের অর্ধশত কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড় থেকে ঢাকা উদ্যান পর্যন্ত সড়কের দুই পাড়ে হামলা চলে সন্ধ্যায়। চাঁদ উদ্যান উত্তর ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সানাউল্লাহ সানি বলেন, আমার কার্যালয়ে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা হামলা করে। অফিসের চেয়ার-টেবিল-টিভি সবকিছু ভাঙচুর করে। একই ঘটনা ঘটেছে ঢাকা উদ্যান এলাকায়। আদাবর ১০০ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি বাচ্চু মিয়া বলেন, আমি অফিসে ছিলাম না। আমি ছিলাম দলীয় কর্মসূচিতে। অফিস ছিলো বন্ধ। আমি খবর পেয়ে এসে দেখি আমার পুরো অফিস ভাঙচুর করা। তিনি আরও বলেন, আমি সিসিটিভিতে দেখি, সন্ধ্যার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ জন লোক আমার অফিসে হামলা করে। আমার অফিস তো রাস্তায় না। এটা টার্গেট করে বিএনপির লোকজন করেছে। যারা হামলা করেছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বাইরের এলাকার। তাদেরকে ভাড়া করে আনা হইছে। বাচ্চু মিয়ার কার্যালয়ের বিপরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় ছিলো আরও দুটি কার্যালয়। যা পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে। গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) হামলা চলে শিয়া মসজিদ মোড়ে। ভাঙচুর চালানো হয় মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের কার্যালয়ে। থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আইমান ওয়াসেক অনিক এই কার্যালয়ে বসতেন। আন্দোলনে অংশ নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা ছিলেন বাইরে। কেউ ধানমন্ডি ২৭, কেউবা অবস্থান নিয়েছিলেন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে। কার্যালয় ছিলো খালি। এ সময় নূরহাজান রোড হয়ে আসা একটি মিছিল হামলা করে ছাত্রলীগ কার্যালয়ে। ভাঙচুরের পর ছাত্রলীগ কার্যালয়টিতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। ভাঙচুর হয়েছে মগবাজার, মালিবাগ এলাকায় থাকা আওয়ামী লীগে বিভিন্ন সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়ে। একই ঘটনা ঘটেছে উত্তরা, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া এলাকায়। একই অবস্থা ছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-কদমতলী এলাকায়। তবে কোটা আন্দোলনে স্থানীয় নেতারা হেলাফেলা করায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান ছিলো থানায় থানায়। অবস্থান কর্মসূচিতে থাকাকালে স্থানীয় কার্যালয় ছিলো ফাঁকা। সে সুযোগে কার্যালয়গুলোতে হামলা চালানো হয়।
আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বলছেন, বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও এমন কোনো সহিংসতা নেই যা করেনি। তারা বাসে, ট্রেনে আগুন দিয়েছে। ট্রেনের লাইন কেটে দিয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছে। পুলিশ পিটিয়ে মেরেছে। সর্বশেষ কোটা আন্দোলনের নামে সারা দেশে যে সহিংসতা চালানো হয়েছে তা বিএনপি-জামায়াত চালিয়েছে। রাজধানীতে মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টুলবক্স, বিটিভি ভবনের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে সেখানে পার্ক করা কয়েকটি গাড়িতে আগুন এবং বিটিভি ভবনের ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন ফ্লোরের বিভিন্ন অংশে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও শত শত গাড়িসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্বালাও পোড়া, ভাঙচুর চালানো হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদীসহ সারা দেশেই সহিংসতা চালিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। তবে কারফিউ ও সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে সরকার। তাই তাদের মাঠ ছেড়ে দিলে আবারও সহিংসতা করতে পারে। কারণ তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাদের মূল টার্গেট দেশ ও দেশের মানুষের জানমালে ক্ষয়-ক্ষতি করা। এখন তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের গুজব ছড়ানোর মধ্যদিয়ে বেকায়দায় ফেলতে ষড়ন্ত্র করছে। তাদের আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আর তারা যদি আন্দোলনের নামে কোনো ধরণের সহিংসতার পথ বেছে নেয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও বসে থাকবে না। তারা আইনি ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে রাজনৈতিকভাবে কঠোর জবাব দেবে। এসবই করবে চলমান কারফিউ উঠে যাওয়ার পর।
দলীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৭দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে মাঠে ছিল শিক্ষার্থীরা। সরকারি দল এবং সরকার তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। তাদের আন্দোলনে প্রকাশে সমর্থন দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ১৮ জুলাই থেকে দেশজুড়ে এক ধরনের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। তবে কোটা আন্দোলনের নামে যারা মাঠে নামবে তাদের প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। আপিল বিভাগের রায়ের আগে শিক্ষার্থীদের জন্য মাঠে নামেননি দলীয় নেতারা। এখন আর শিক্ষার্থীদের কোনো ইস্যু নেই। তাই কারফিউয়ের পরে যদি দুষ্কৃতকারী আন্দোলনে নামে দলের নেতাকর্মীরাই তাদের প্রতিহত করবেন। এ জন্য রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে মোড়ে এবং অলিগলিতে অবস্থান নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। এবার কোনো হেলাফেলা করবে না তৃণমূল নেতাকর্মীরা। দলীয় নেতাকর্মীরা সজাগ থাকবে, সর্তক থাকবে। পাড়া-মহল্লায় সংঘটিত হয়ে যেখানে এদের পাওয়া যাবে, অপরিচিত লোক দেখলেই তাদের পরীক্ষা করবে দলের নেতাকর্মীরা। অচেনারা পাড়া-মহল্লায়, মেসে, বিভিন্ন বাসায় ভাড়া করে আছে। তাদের চিহ্নিত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সোপর্দ করবে। শুধু তাই নয়, আগামী দিনগুলো দলীয় নির্দেশনা মেনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কোথাও কোনো অপরিচিত ব্যক্তি দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে অপরিচিতদের চলাফেরার দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে। দলের দুর্দিনে সকল নেতাকর্মীদের রাগ অভিমান ভুলে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ফোন দিয়ে সক্রিয় হতে বলছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে। কারফিউ উঠে যাওয়ার পরের পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, এদের (সহিংসতাকারীদের) আইনের আওতায় এনে কঠোর ভাবে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের জীবন রক্ষার জন্য, যা যা করা দরকার সব কিছু আইনিভাবে করা হবে। কোনো ছাড় নয়, এদের রেহাই দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, দলীয় নেতাকর্মীরা সজাগ থাকবে, সর্তক থাকবে। একইসুরে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি। তিনি বলেন, আমরা অনেক ধৈর্যধারণ করেছি। এখন থেকে পাড়া-মহল্লায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপরিচিত লোক দেখলেই তাদের পরীক্ষা করবে দলের নেতাকর্মীরা। অচেনারা পাড়া-মহল্লায়, মেসে, বিভিন্ন বাসায় ভাড়া করে আছে। তাদের চিহ্নিত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সোপর্দ করবে। কোটা বৈষম্য আন্দোলনের নামে আর কেউ যেন সহিংসতা করতে না পারে সে জন্য দলীয় নেতাকর্মীকে পাড়া-মহল্লা ও সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সরকারকে হটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে দেশের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। এ সময় দলীয় নেতাকর্মীদের ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান মন্ত্রী মোজাম্মেল হক।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* দলের দুর্দিনে রাগ-অভিমান ভুলে নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় হতে হাইকমান্ডের নির্দেশ * রাজধানীর মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেবে আ’লীগের থানা-ওয়ার্ড নেতারা * সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করার নির্দেশ
কারফিউ শেষে মাঠ দখলে ‘কঠোর’ অবস্থানে আ’লীগ
- আপলোড সময় : ২৭-০৭-২০২৪ ১২:১৬:৩০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৭-০৭-২০২৪ ১২:১৬:৩০ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ