কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে কাঁদানে গ্যাস ও ছররা গুলিতে চোখে আঘাত পেয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৪ জন। এর মধ্যে চোখের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ২৭৮ জনের। অস্ত্রোপচার করা বেশির ভাগ রোগীর চোখে ছররা গুলির আঘাত ছিল। অপরদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ২০ জনের মতো আহতের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও লেগেছে দুটি গুলি। অনেকগুলো ছররা গুলির ক্ষত নিয়েও ভর্তি কেউ কেউ। আহতরা হাসপাতালে ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আন্দোলন চলাকালে গত বুধবার থেকে গত শনিবার (১৭ থেকে ২২ জুলাই) পর্যন্ত ৬ দিনে ওইসব রোগীরা হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে যান। এর মধ্যে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত ৩১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তবে মঙ্গলবারের মধ্যে তাদের অধিকাংশই চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। অনেকেই এখনো চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে অবস্থান করছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কারও কারও চোখে একাধিকবার অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। চোখের আলো ফিরবে কি না এমন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা।
গত মঙ্গলবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে হাসপাতালের নিচতলায় জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষের পাশেই পর্যবেক্ষণ কক্ষের একটি বিছানায় শুয়ে ছিলেন হাবিবুর রহমান। তার চোখে কালো চশমা ও মাথায় ব্যান্ডেজ। চশমা সরাতেই চোখের ক্ষত স্পষ্ট দেখা গেল। চোখের কালো ও সাদা অংশও পুরোটাই গাঢ় লাল হয়ে আছে। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) মাঝরাতে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে হাবিবুরকে ভর্তি করানো হয়।
হাবিবুর রহমান ডেমরা এলাকার বাসিন্দা। তিনি ডেমরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজমেন্ট) বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তার ডান চোখে ও মাথায় ছররা গুলি লেগেছে। এতে হাবিবুরের চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবেন কি না, সে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি। হাবিবুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে তিনি যাত্রাবাড়ীর কাঁচাবাজারের সামনের সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে মিছিল করছিলেন। সঙ্গে তার সহপাঠী ও বন্ধুরা ছিলেন। হঠাৎ পেছন দিক থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে কিছু লোক এসে এলোপাতাড়ি গুলি করে চলে যায়। তখনই তিনি মাথায় ও চোখে গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে হাবিবুরের সঙ্গে ছিলেন তার মা মর্জিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে আমরা সেখানে ছুটে যাই। ছেলের মাথায় ছররা গুলি লেগেছিল। তাই ঢাকা মেডিকেল থেকে ছেলেকে মালিবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই হাসপাতালে মাথায় অস্ত্রোপচারের পর চোখের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে পাঠানো হয়। মর্জিনা আক্তার আরও বলেন, এখানে শনিবার ছেলের একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে চোখে এখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ কারণে চিকিৎসকরা মঙ্গলবার বিকেলে আরেকটি অস্ত্রোপচার করবেন বলে জানিয়েছেন। এখন সেটার জন্যই অপেক্ষা করছি।
দৃষ্টিশক্তি হারানোর শঙ্কায় হাসপাতালটির চতুর্থ তলায় ৪৫১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বরিশাল সদরের নথুল্লাবাদ এলাকার বাসিন্দা রাকিবুল আহসান। তিনি বিএম কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় রাকিবুলসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। বিকেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর একদল লোক হামলা চালায়। সেখানেই ডান চোখে গুলি লাগে রাকিবুলের। রাকিবুল আহসান জানান, বুধবার পর্যন্ত বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এখানে ভর্তি করা হয়। পরদিন চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। রাকিবুল আহসান আরও বলেন, ডান চোখে এখনো ঝাপসা দেখি। মঙ্গলবার সকালে বড় ডাক্তাররা ভিজিটে এসেছিলেন। তারা আরও তিনটি পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, আমার চোখে আলো ফেরার অর্ধেক-অর্ধেক সম্ভাবনা রয়েছে। আন্দোলনকারী ছাড়াও পথচারী, কর্মজীবী, সাধারণ মানুষসহ অনেকেই গত কয়েক দিনের বিক্ষোভ-সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ছররা গুলিতে কিংবা ইটপাটকেলে চোখে আঘাত পেয়েছেন। তাদের একজন মিরপুর-১ নম্বরের বাসিন্দা জিহাদ মাহমুদ। কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় সহিংসতার মধ্যে তার চোখে ও শরীরে ছররা গুলি লাগে বলে জানান তিনি। একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থী জিহাদ হাসপাতালের ৪১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন।
জিহাদ মাহমুদ জানান, মিরপুর-২ নম্বরে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে তিনি বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) পরিস্থিতি খারাপ থাকায় দোকানে ক্রেতা একেবারেই ছিল না। তাই তাদেরও বিকেলের মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে দারুস সালাম থানা এলাকা দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। গণ্ডগোল দেখে তিনি একটি বাসের পেছনে গিয়ে লুকান। তখনই তার শরীরে ও চোখে ছররা গুলি লাগে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক গোলাম মোস্তাফা মুঠোফোনে বলেন, চোখে বিভিন্ন ধরনের আঘাত নিয়ে যারা এসেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছররা গুলিতে আহত। তাদের প্রাথমিক অস্ত্রোপচার যেটা প্রয়োজন, সেটা দেয়া হয়েছে। অনেকে অস্ত্রোপচারের পর ছাড়পত্র নিয়ে চলেও গেছেন। ওই রোগীরা প্রতি সপ্তাহে ফলোআপের জন্য আসবেন। তবে আস্তে আস্তে বোঝা যাবে দৃষ্টি কতটুকু ফিরছে।
অপরদিকে, হাসপাতালটিতে গত মঙ্গলবার গিয়ে আহতদের মধ্যে দেখা গেল একটি কিশোরকে। তার দুই পায়ে দুটি গুলি লেগেছে। পা দুটো ব্যান্ডেজ করা। পাশে বসা তার মামা। গিয়ে কথা বলতে চাইলে মামা সবকিছুই বললেন। তবে অনুরোধ জানালেন, তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় যেন প্রকাশ করা না হয়। আহত ব্যক্তির মামার দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মিরপুরে সংঘর্ষের সময় বাসায় ফিরতে গিয়ে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) গুলিবিদ্ধ হয় তার ভাগনে। ঘটনাস্থল মিরপুর-১০ নম্বর সেকশন। আহত কিশোরটি স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আহতের মামা আরও বলেন, তার ভাগনের দুই পায়ে যে দুটি গুলি লেগেছে, তা রাবার বুলেট বা ছররা গুলি নয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীটির ততটা ঝুঁকি নেই। তবে কারও কারও পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাদের একজন জাকির শিকদার। তিনি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে ভর্তি। বয়স ২৭ বছর। সংঘর্ষের মধ্যে ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ঢাকার মধ্যবাড্ডা এলাকায় তার বাঁ পায়ে গুলি লাগে। পাটি ইতোমধ্যে অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন চিকিৎসকরা। জাকির নিজেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী বলে উল্লেখ করেন। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘শরীরের ব্যথা তো কিছু না ভাই। আমি তো পঙ্গু হয়ে গেলাম! পরিবারের বোঝা হয়ে গেলাম।’ তিনি দাবি করেন, কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তার পায়ে গুলি লাগে।
জাকিরের বাড়ি মাদারীপুর সদরে। তার বাবা শাহজাহান শিকদার ২০০৭ সালে মারা যান। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোট ভাই ও মাকে নিয়ে তিনি মধ্যবাড্ডায় ভাড়া থাকেন। পঙ্গু হাসপাতালে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তার মা হনুফা বেগম পাশে বসে চোখ মুছছিলেন। তিনি শুধু বলছিলেন, ‘আমার ছেলে (জাকির) সবাইকে দেখে রেখেছিল, এখন আমার ছেলেকে কে দেখবে?’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে সংঘাত আরও বাড়ে। ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই সংঘাতে এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অন্তত ২০১ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থী, তরুণ ও প্রবীণ নাগরিক এবং তিনজন পুলিশ সদস্য ও একজন আনসার সদস্য রয়েছেন। আহত বহু মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শফিউর রহমান বলেন, গুলিবিদ্ধ রোগীদের পাশাপাশি ১২ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালটিতে আনা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, কয়েক দিন পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল। রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

চোখে অস্ত্রোপচার ২৭৮ জনের চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৪ জন
- আপলোড সময় : ২৬-০৭-২০২৪ ০২:৪৭:১৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৬-০৭-২০২৪ ০২:৪৭:১৫ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ