ঢাকা , মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ২৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
শ্রীমঙ্গলে হঠাৎ বাড়ছে শীত হাটহাজারীতে পাঁচ ইটভাটায় ৬ লাখ টাকা জরিমানা ঠাকুরগাঁও বিশেষ অভিযানে আ’লীগের ১৫ নেতাকর্মী গ্রেফতার পোরশায় ধাতব দ্রব্যের সন্ধানে মাটি খনন বখাটেদের হামলায় আহত যুবকের মৃত্যু ইটভাটা বন্ধে কর্মহীন সহশ্রাধিক শ্রমিক বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির এমডি খুঁটির জোর কোথায়? নাহিদ রানাকে নিয়ে চিন্তিত নয় টাইগার কোচ প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতলো দুবাই ক্যাপিটালস এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের দল ঘোষণা সেভিয়ার বিপক্ষে বার্সার দাপুটে জয় এফএ কাপে বড় অঘটন, লিভারপুলের বিদায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বুমরাহর খেলা নিয়ে সিদ্ধান্ত আজকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের সিরিজ জয় বাংলাদেশের বিপক্ষে সবসময় চাপে থাকে ভারত ডিআইজি মোল্যা নজরুল রিমান্ডে অপরিবর্তিত থাকছে নীতি সুদহার দুদকের জালে এবার সহকারী হজ’র মালেক ২৫ কর্মকর্তার নামে লকার খুঁজে পায়নি দুদক ইট রড অন্যান্য সামগ্রী খুলে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে

বাঙালির চিরাভ্যস্ত অর্জন ’৭১-এর মার্চ

  • আপলোড সময় : ২৯-০২-২০২৪ ১০:০২:৩১ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৯-০২-২০২৪ ১০:০২:৩১ পূর্বাহ্ন
বাঙালির চিরাভ্যস্ত অর্জন ’৭১-এর মার্চ
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এরপর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু-উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে একটি বিদ্রোহী কণ্ঠ জিন্নার ঘোষণার উত্তরে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাঙালি। পূর্বপাকিস্তানকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এসময় মধ্যযুগীয় অত্যাচার ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ১৯৬৬-এর ৭ মার্চ ছয় দফার বাস্তবায়ন আন্দোলনে বাংলাদেশে গর্জে উঠল তীব্রভাবে। এরপর ছয় দফার ম্যান্ডেট নিয়ে পাকিস্তান ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন আওয়ামী লীগ পেয়েও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বানচাল করার কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগনিষ্ঠরতা ক্ষমতায় বসতে পারেনি। যাহোক বাংলার স্বাধীনতা ৯ মাসের যুদ্ধের বিনিময়ে নয়। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পূর্ব থেকেই পূর্বপাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের উৎপত্তি। আমাদের স্বাধীনতার পটভূমি হঠাৎ করে হয়নি। এর পিছনে অনেক ঘটনাবালি নিহিত ছিল ১৯৭১-র মার্চ এর পর স্বাধীনতা, ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকেই। আমাদের জাতীয়তাবোধের সবকিছুই বাঙালি শিখেছে ভাষা আন্দোলন থেকেই। আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষায় কথা বলি, আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশি-এসব বোধ এ আন্দোলন থেকেই পাওয়া। ভাষা আন্দোলন থেকেই দেশটি স্বাধীন হয়েছে চীনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবস্থান ঘোষণা করে এবং তখনকার তাদের সমর্থক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তীব্র সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর যখনই দেশটি প্রবল কোনো সংকটে আক্রান্ত হয়েছে তখনই স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারগুলো বা বিরোধীদলগুলো কোনো না কোনোভাবে তাদেরই শরণাপন্ন হয়েছেন। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ছিল বাংলাদেশের একটি ব্যতিক্রম সংকট, কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর জনগণের কঠোর শ্রমের মাধ্যমে অর্থনীতির কিছু বিকাশ ঘটলেও মূল্যবোধ, রাজনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসন, সর্বত্র এক ভয়াবহ ধস নেমেছিল। সেসময় বাংলার অর্থনীতির বিলাপ ছিল মহাসংকটে। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে বাংলায় নিজ দেশের মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধু প্রথম জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় এক বক্তব্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির বিভিন্ন বিষয়গুলো তুলে ধরেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ১৯৭৪-র ভাষণ ছিল তার জাতিসংঘের প্রথম ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূল চেতনাটি এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বোভৌম বাংলাদেশ। এটি বাঙালির চিরভ্যস্ত অর্জন। যার মনোবৃত্তি বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের মনীষা (তীক্ষè বুদ্ধি) নেতৃত্বে এদেশের গণমানুষের। স্বাধীনতা যুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি, নয় মাসের এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে লেগেছে বহু বছর। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথপরিক্রমা পার করতে হয়েছে এ বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে। ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ক্ষমতায় এসেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর যে নির্যাতন, অপশাসনের রক্তক্ষয়ী মধ্যদিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি রচিত হয়েছে ১৯৭১-র মহান মু্িক্তযুদ্ধ। ১৯৪৮ সাল থেকে হাজারো অন্যায়-অবিচারের স্টিম রোলার চলছে এ জাতির উপরে। ১৯৭১-র ‘মার্চ’ শব্দটি মনে হতেই ভেসে উঠে রক্তের চাদরে মোড়ানো একটি সবুজ দেশের মানচিত্র। তবে আমি মুক্তিযুদ্ধ স্বচক্ষে দেখিনি, দেখিনি সেই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। শুধু ইতিহাস পর্যালোচনার স্ব-স্বপ্নের উপলব্ধি থেকে খানিকটা আঁচ করে বঝতে পেরেছি স্বাধীনতা মানেই সর্বাধিক বেদনাদায়ক এবং একইসঙ্গে সাল্য জনক একটি অধ্যায়। বেদনার বিষয় এই কারণে যে, পাকিস্তানের লাগামহীন অত্যাচার-অবিচার ও হিংসা শিকার হয়ে লাখো বাঙালিকে জীবন হারাতে হয়েছিল, সম্ভ্রম হারিয়েছিল অসংখ্য মা-বোন আবার যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধে স্বামী বিয়োগ একজন নারী একাকী বিছানায় বসে কাঁদছেন, সন্তানহারা আশি বছরের বৃদ্ধা ‘মা’, যখন ১৯৭১-র কথা বলতে গেলেই খাবলা মুখে কেঁদে পড়েন, আবার যখন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখি তখনই মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্মরণে বেদনাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাঙালির জাতীয় পথচলায় স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে অমর হয়ে আছে আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ আর সে কারণেই একাত্তর আজও ষোল কোটি বাঙালির প্রাণের প্রেরণায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেবেও ঘুণে ধরা এই স্বার্থভিত্তিক সমাজে যখন অপরকে সুখী করতে কেউ সশরীরে একটি ফুলের আঁচড় নিতেও রাজি নয়, যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির দিকে শকুনের ন্যায় লোলুপ দৃষ্টি ফেলে রেখেছে, জাতির ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, সন্ত্রাসীরা স্বজাতির নিরীহ মানুষগুলোকে আগুন দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে, গুম-হত্যা করছে। তখনই একাত্তরের সেই নিঃস্বার্থ চেতনা বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। নিপীড়িত, অত্যাচারী, জনমদুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য রক্তে শিহরণ জাগানো সেই সেøাগান আজ যেন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, ‘মোরা একটি হাসির জন্য যুদ্ধ করি’। মোরা একটি ফুল বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’।
 ১৯৭১-র মার্চের একেকটি দিন ছিল একেকটি ইতিহাস। আর এই ইতিহাস থেকেই বিভিন্ন লেখক ও গুণীজনরা খণ্ড- খণ্ডভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন ১৯৭১-এর উত্তাল মার্চের রক্ত স্রোতে ভেসে আসা বাঙালির কাক্সিক্ষত মহান স্বাধীনতার চেতনাকে। ইতিহাস পর্যালোচনার তথ্যে ১৯৭১-এর মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে চিরভাস্বর ইতিহাস। ইতিহাস সৃষ্টিকারী ১৯৭১-এর মার্চ মাস বাঙালির হৃদয় চির জাগরূক-চিরভাস্বর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, শোষণ-বঞ্চনা, জেল-জুলুম আর তীব্র বর্বরতা অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি। ১৯৭১-এর মার্চ মাসের দিনগুলোর মতো এমন অগ্নিঝরা, ঘটনাবহুল সমুজ্জ্বল কোনো মাস জাতির জীবনে আর আসেনি। তাই প্রতি বছরের মতো রক্তঝরা আন্দোলন-সংগ্রাম আর প্রেরণার মাস মার্চ এলেই বাঙালির রক্তে শিহরণের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর কথা। মহাকালের মূর্ণায়মন চাকায় ভর করে প্রতিবারই যখন সেই ঐতিহাসিক মার্চ মাস আসে, তখনই অসংখ্য গৌরবদীপ্ত স্মৃতির সাগরে ডুবে যায় গোটা বীরের জাতি। একাত্তরের ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনার উজ্জ্বল সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হওয়া বীর সন্তানদের মধ্যে কেউবা চাপা মাটিতে চির নিন্দ্রায় শায়িত আবার সন্ধান না পাওয়া শহিদদের হাজারো লাশ নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা-নালায় পচে-গলে কুকুর, শকুন, চিল ও মাছের সুস্বাদ খাবারে পরিণত হয়েছিল আবার কখনো বা মৃত্যুর ভয়ে শিশু-সন্তান নিয়ে বন-জঙ্গলে লুকায়িত বাঙালি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম হত্যার লাশগুলো কাক-চিলের খাদ্যে পরিণত হয়েছিল সেই অগ্নিঝরা মার্চের প্রতিটি দিনে। একাত্তরের রক্তঝরা মার্চে বীর বাঙালি সেই যে শপথ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বা দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফিরবে না, হাজারো বীরসেনা মায়ের কোলে সত্যিই ফিরেনি এখনো, হয়ত বা ফিরবে না আর কোনো কালেই।
 
লেখক : কলামিস্ট  
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স