কোটা সংস্কার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এখন ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে ক্যাম্পাসগুলো ছিল কার্যত রণক্ষেত্র। এরইমধ্যে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহিরাগত ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে সংগঠনটির অনেক নেতাকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাঝে পড়েছে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের হিড়িক। ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করার ঘটনা সামনে এসেছে। বহিরাগত টোকাই শ্রেণীর ছাত্রলীগ কর্মীদের এনে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আহত করার প্রতিবাদে এই পদত্যাগ বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী।
গত রোববার গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের পর থেকে এই পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আসে। প্রথমে এদিন রাতের মধ্যেই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন ছাত্রলীগ নেতা। পরবর্তীতে গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত যুবকদের এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর রাতেই পদত্যাগ করেন আরো অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেয় অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদত্যাগকারীদের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম হৃদয়, একই অনুষদের উপ-সম্পাদক জেবা সায়ীমা, সার্জেন্ট জহরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ওয়াসিক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসিবুল হাসান হাসিব, শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের উপ-পাঠাগার সম্পাদক ইসরাত জাহান সুমনা, বিজয় একাত্তর হল শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা উপ-সম্পাদক শাহ সাকিব সাদমান প্রান্ত, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের অর্থ সম্পাদক জুয়েনা আলম মুন, নাট্য ও সাহিত্য সম্পাদক মেহেরুন্নিসা মিম, একই হলের আইন সম্পাদক সিরাজাম মনিরা তিশাসহ বিভিন্ন হল এবং অনুষদের অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। এর আগে, গত রোববার রাতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এর প্রতিবাদে ও কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রলীগের ৩ জন নেতা পদত্যাগ করেন। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক উপ-সম্পাদক রাতুল আহামেদ ওরফে শ্রাবণ এবং আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান ওরফে জিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সহ- সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করা শিপন মাহমুদ ফেসবুকে লেখেন, আমি চলমান ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করছি। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শোকজ খাওয়া এবং মুচলেকার মুখে পড়া ছাত্র আমি। আমি আজীবন নজরুল। প্রতিবাদ করা আমার রক্তে। আমি আজন্ম প্রতিবাদী পুরুষ। আমি মো. শিপন মিয়া, সহ-সভাপতি, বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চলমান যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বিজয় একাত্তর হল-এর সহ- সভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম। অন্যায় আর শিপন এক লাইনে থাকে না। জুয়েনা আলম মুন বলেন, ছাত্রলীগকে ন্যায়ের কাণ্ডারি ভেবে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু এখন এই সংগঠনের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা ছিলো এটাও মনে করলে আমার রক্তাক্ত বন্ধু-বান্ধবী, সিনিয়র, জুনিয়রদের চেহারা মনে পড়বে। তাই স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে পদত্যাগ করছি। হাসিবুল হাসান হাসিব বলেন, ছাত্রলীগের সাথে আমার পূর্বের সকল সম্পর্ক ত্যাগ করলাম, আমার ছোটভাই বন্ধুদের অনেককে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। ঘৃণা হচ্ছে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসাবে এতদিন কাজ করায়। বিদায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শাহ সাকিব সাদমান প্রান্ত বলেন, আজকের পর থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে বাকী জীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নাই। পুলিশ ভেরিফিকেশন, তদবির, কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে অন্য যেকোনো ধরনের অসহযোগিতা ও সকল ধরনের কনসিকোয়েন্স মাথায় রেখে, কারো প্ররোচণায় না বরং বিবেকের তাড়নায় ও সজ্ঞানে আমি বিজয় একাত্তর হলের ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করলাম। একদিকে পদত্যাগের হিড়িক অন্যদিকে ত্যাগী নেতাদের চলছে পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপে নেতারা লিখছেন, এখন আপনাদের পরীক্ষার সময়। এখনকার অবস্থানের ওপর নির্ভর করবে আপনাদের পদ-পদবি। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী রাহাত ইসলাম বলেন, যারা এই ক্রান্তিলগ্নে পদত্যাগ করছেন তারা আসলে ছাত্রলীগের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদী। তারা এতদিন ছাত্রলীগের এই পদ-পদবিকে হলে শান্তিতে থাকার হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। নেতাকর্মীদের এমন পদত্যাগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, মূলত প্রতিটি রুমে রুমে গিয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা তাদেরকে জোরপূর্বক পদত্যাগের স্ট্যাটাস দেয়াচ্ছে।
কুবিতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পদত্যাগের হিড়িক: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পদত্যাগ করছেন। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। গত সোমবার রাত ১০টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রলীগ কর্মী তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দেয়ার মাধ্যমে এ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ছাত্রলীগকে অবাঞ্ছিত ও পদত্যাগ করার ঘোষণা অব্যাহত আছে। তবে পদত্যাগকারী নেতাকর্মীরা জানান, সারা দেশের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা চালায়। এই ঘটনায় তারা নিন্দা জানিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন। পোস্টে এক পদত্যাগকারী লেখেন, অতীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এটা জেনে যে, ছাত্রলীগ ছাত্রদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। তবে বর্তমান ছাত্রলীগ যা বোঝাল, এতে এই মুহূর্ত থেকে আমি আর কোনোভাবেই ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে প্রথম পদত্যাগকারী নুসরাত জাহান সুরভী বলেন, আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। আপনিও জানেন দেশে কী হচ্ছে। সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি হল শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
ছাত্রলীগ নেতাদের পদত্যাগের হিড়িক
- আপলোড সময় : ১৭-০৭-২০২৪ ০৩:৫৪:২৯ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৭-০৭-২০২৪ ০৩:৫৪:২৯ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ