গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালে একটি এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত কয়েক সপ্তাহে গ্যাস সংকট আরও বেড়েছে। জানা যায়, সমুদ্রে দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) রয়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বা রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত এ স্টেশনের মাধ্যমে সমুদ্রে থাকা ট্যাঙ্কারগুলো থেকে এলএনজি কার্গো লোডিং ও আনলোড করা হয়। সেগুলোর কোনো একটি যখন অকেজো হয়, তখন চরম ভোগান্তিতে পড়ে পুরো দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের টার্মিনালগুলোর কোনোটি ভাসমান আবার কোনোটি স্থলে। তবে বাংলাদেশে থাকা এলএনজি টার্মিলানের দুটিই ভাসমান। মূলত এই এলএনজি টার্মিনাল উপকূলের কাছে থাকা একটি বিশেষ জাহাজ। দুর্যোগপূর্ণ অবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার পরে নিরাপদ রাখার জন্য এই এফএসআরইউ গভীর সমুদ্রে স্থানান্তর করা হয়। জ¦ালানি বিভাগের তথ্য বলছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে থাকা এই এফএসআরইউ দুটির একটি সামিট গ্রুপের, অন্যটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির। ২০১৮ সাল থেকে কোম্পানি দুটির সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি রয়েছে জ¦ালানি বিভাগের। এর প্রতিটির ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনে টার্মিনাল দুটির সক্ষমতা প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। টার্মিনাল দুটি একসঙ্গে চালু অবস্থায় প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস সরবরাহ এবং টার্মিনাল দুটি পূর্ণমাত্রায় চালু থাকার পরও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের ঘাটতি থাকে। এর মধ্যে কোনো একটি টার্মিনাল বন্ধ হলে তীব্র গ্যাস সংকট দেশবাসীকে ভোগায়। বাসাবাড়িতে রান্নার বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে কলকারখানার উৎপাদন কার্যক্রমও ব্যাহত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কারিগরি ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে বাংলাদেশে থাকা এফএসআরইউ দুটির কোনো না কোনোটি প্রায়ই বন্ধ থাকছে। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিট গ্রুপের এফএসআরইউ। এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে। এতে গ্যাস সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর টার্মিনালের কারিগরি ত্রুটি দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণে যায়। সে সময়ও দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই ল্যান্ডবেজড বা ভূমিতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। এফএসআরইউ একটি অস্থায়ী সমাধান। এটি কখনো দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হতে পারে না। এদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এমনিতেই দীর্ঘদিন গ্যাস-সংকটে ভুগছে শিল্পখাত। এ সংকট থেকেই সরকার গ্যাস আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি শুরু হয়। সম্প্রতি গ্যাস-সংকটের সমাধান চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিসিএমইএ)। চিঠিতে সংগঠনটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা উল্লেখ করেন, সিরামিক কারখানার চুল্লি চালাতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাসের সরবরাহ থাকতে হয়। গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই ছাড়া চুল্লির ভেতরে উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। গ্যাসের চাপ কমে গেলে চুল্লির ভেতরে থাকা সব পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। আর একবার চুল্লি বন্ধ হলে চালু করতে সর্বনিম্ন ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে। গ্যাস সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান রুগণ হয়ে পড়লে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে বলেও চিঠিতে সতর্ক করা হয়। তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে টেক্সটাইল মিলগুলো স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। কয়েক মাস ধরে মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার গড়ে ৪০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে সুতা ও কাপড়ের উৎপাদন কমেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ ফেব্রিক প্রসেসিং ব্যয়ও বেড়েছে, যা এ খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এদিকে সম্প্রতি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে লেখা এক চিঠিতে একথা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। চিঠিতে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার, আশুলিয়া, মাওনাসহ দেশের অন্য এলাকায় অবস্থিত স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ করা হয়। বিটিএমএ চিঠিতে আরও জানায়, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের সরাসরি প্রভাব রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে পড়েছে। গ্যাসের অভাবে যদি বিটিএমএর মিলগুলো সময়মতো তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সুতা ও কাপড় সরবরাহ করতে না পারে তাহলে যথাসময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করা সম্ভব হবে না। এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও সরবরাহ বাড়েনি। জানা যায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাস ট্যারিফ প্রতি কিউবিক মিটার ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা ধার্য অর্থাৎ ৯৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বাড়িয়ে আশ্বস্ত করা হয়, এরপর থেকে শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কিন্তু বিগত এক বছরের বেশি সময় মিলগুলো বর্ধিত গ্যাস ট্যারিফ দিলেও গ্যাসের সরবরাহ কখনোই কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। ফলে মিলগুলোর উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানি আদেশ পরিপালন করতে পারছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, মিল মালিকরা সাধারণ কথাবার্তা বলছেন। একটি পাইপলাইন থেকে দুই অথবা তিনটি কলকারখানা সংযোগ পেতে পারে। কিন্তু আলাদা পাইপলাইন না করে একই পাইপলাইন থেকে তিতাসের কাছ থেকে তারা ১০ জন সংযোগ নিচ্ছে। একটি পাইপলাইন থেকে এভাবে ১০ জন সংযোগ নেওয়ায় গ্যাস থাকা সত্ত্বেও শেষ প্রান্তের গ্রাহক পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছে না। অন্যদিকে এ বিষয়ে তিতাস বলছে, এই লাইন তিতাস দেয় না বা কিছু করে না। এগুলো দেশের বিষয়, দেশে ইন্ডাস্ট্রিলাইজেশন করার স্বার্থে বোর্ড মিটিংয়ে ডিসিশন হয়। এটি ইচ্ছে করে কেউ কাউকে দেয় না। গ্যাস আনে পেট্রোবাংলা, তিতাসের কাজ হলো বিতরণ করা। একটি এফএসআরইউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৫০০ মিলিয়ন ফুট গ্যাস কাট হয়েছে। এএটি এই মাসের মাঝামাঝি চলে এলে সংকট কেটে যাবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

গ্যাস সংকটে শিল্প কারখানার উৎপাদন কমছে
- আপলোড সময় : ১২-০৭-২০২৪ ০৩:৫৪:৩৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১২-০৭-২০২৪ ০৩:৫৪:৩৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ