সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা জমা দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্নকারীদের ৭৬ শতাংশই দরিদ্র, যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। আর স্কিমে এখন পর্যন্ত বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। তবে দরিদ্র মানুষ যেহারে এই পেনশনের আওতায় আসছেন, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা সেহারে আসছেন না। বর্তমানে জমাকৃত চাঁদার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে মোট নিবন্ধন হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার। সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। গত বছরের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেন। এর পরপরই আবেদন শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা- এই চার স্কিম নিয়ে সরকার সর্বজনীন পেনশন চালু করে।
পরবর্তী সময়ে সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালু করার ঘোষণা দেয়া হয়। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে এ স্কিম কার্যকর হয়েছে। শুরুতে সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও মাঝে নিবন্ধনে কিছুটা ধীরগতি আসে। তবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে হু হু করে বাড়তে থাকে নিবন্ধন করে চাঁদা জমা দেয়া মানুষের সংখ্যা। এপ্রিলে ৬০ হাজার মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে। এতে ওই মাসে সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধনের সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করে। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর আট মাস পরে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখ ছোঁয়। এরপর মে ও জুন মাসেও বিপুলসংখ্যক মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দিয়েছে। ফলে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা দ্রুততম সময়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হয়ে গেছে। জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে যারা নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দিয়েছেন তাদের সিংহভাগ দরিদ্র মানুষ। গত ২৯ এপ্রিল বিকাল ৫টার দিকে নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধকারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৩৮ জন। এরমধ্যে ৫৪ হাজার ৪৫৫ জন ছিলেন যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। গত দুই মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নতুন করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯০৪ জন। এরমধ্যে ২ লাখ ৩ হাজার ৫০ জনের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত দুই মাসে নিবন্ধন সম্পন্নকারীদের ৮৫ শতাংশই দরিদ্র।
সমতা স্কিমে নিবন্ধন দ্রুত বাড়ার কারণ জানতে চাইলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, লোকাল প্রশাসনের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে বলেই নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ বুঝতে পারছে ৫০০ টাকা দিলে সরকার আরও ৫০০ টাকা দেবে, এতে ভবিষ্যৎ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মানুষ বুঝতে পারছে বলেই করছে। বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা এটা নিশ্চিত করছেন কীভাবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এই সার্টিফিকেট দিতে পারি, ওই সার্টিফিকেট দিতে হবে- এমন কোনো ব্যারিয়ার দেইনি। যার কাছে নিবন্ধন করতে আসছেন, তাকে তার (নিবন্ধকারী) সামাজিক অবস্থান পরীক্ষা করে নিতে বলেছি। তিনি কী করেন, তার পেশা কী, আর তার সামাজিক অবস্থান দেখলেই বোঝা যায় তিনি আসলে কেমন। গোলাম মোস্তাফা বলেন, যারা সমতায় আসবেন, তাদের জন্য চাঁদার হার একটাই। আর মেয়াদ শেষে যে পেনশন পাবেন, তা যিনি ওয়েল-অফ তার জন্য মানানসই না। এখন নিজের বুঝ তো পাগলেও বোঝে। যে ওয়েল-অফ সে চিন্তা করবে আমি যে ১০ বছর বা ২০ বছর জমাবো, যখন আমি পেনশন পাবো তখন কি এটা আমার জীবনযাত্রার সঙ্গে যায়? তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বলেন, যদি কখনো আমাদের কাছে মোটা দাগে কোনো কিছু ধরা পড়ে, আমরা তাদের পরিবর্তন করে দেবো। পরিবর্তন তো সব সময় করা যায়। সমতায় গেলো নাকি সুরক্ষায় গেলো এটা নিয়ে এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তা করার দরকার নেই। আমার চিন্তা সে একটা সামাজিক সুরক্ষা স্কিমের মধ্যে এলো কিনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জনা যায়, গত মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩ লাখ ৪০ হাজার ২৪২ জন। তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ কোটি ৮০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এরমধ্যে ৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ, যাদের বর্তমান আয়সীমা বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এই শ্রেণির মানুষের জন্য চালু হয়েছে সমতা স্কিম। এই স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫০৫ জন। তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ ৩৩ কোটি ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধকারীদের ৭৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। এই স্কিমের মাসিক চাঁদার হার ১ হাজার টাকা। এরমধ্যে স্কিম গ্রহণকারী চাঁদা দেবেন ৫০০ টাকা এবং বাকি ৫০০ টাকা দেবে সরকার। এদিকে নিবন্ধন সম্পন্ন করে সবচেয়ে বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। তাদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে এরই মধ্যে চাঁদা জমা পড়েছে ৩৪ কোটি ৭৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। এই স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৭৯৩ জন। জমা পড়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, জমা পড়া চাঁদা থেকে এরই মধ্যে ৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রবাসীদের নিবন্ধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো প্রবাসীরা সবচেয়ে কম নিবন্ধন করেছেন। প্রবাসীদের কাছ থেকে এখনো আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দিয়ে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে পেনশনারের নমিনি পেনশন স্কিম গ্রহণকারীর ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেয়ার আগেই মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তা নমিনিকে ফেরৎ দেয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পেনশন স্কিমের সবচেয়ে বড় জিনিস এটা ম্যানেজ করা, কার্যকর করা। যাদের জন্য যে স্কিম তারা সেই স্কিমে নিবন্ধন করছেন কিনা, সেটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

# জমাকৃত চাঁদার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা # চাঁদা জমা দেয়ার অধিকাংশই বেসরকারি চাকরিজীবী # মোট নিবন্ধন হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার
সর্বজনীন পেনশনে টাকা জমা করা ৭৬ শতাংশই দরিদ্র
- আপলোড সময় : ০৩-০৭-২০২৪ ১১:৫১:০২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৩-০৭-২০২৪ ১১:৫১:০২ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ