
নতুন অর্থবছরের পথচলা শুরু * রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা
চ্যালেঞ্জিং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কৌশলী এনবিআর
- আপলোড সময় : ০১-০৭-২০২৪ ১০:১৫:৩৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৭-২০২৪ ১১:২৩:৩২ পূর্বাহ্ন


চ্যালেঞ্জিং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কৌশলী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গতকাল সোমবার থেকে নতুন অর্থবছর ২০২৪-২৫ কার্যকর হয়েছে। গত রোববার সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পাস হয়েছে। এবারের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বেশি। উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা, অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধ সব মিলিয়ে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি এনবিআর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত অর্থবছরে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও, এবার লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সংস্থাটি। নতুন অর্থবছরে ভ্যাট ও আয়কর খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া শুল্ক থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বড় অংশ আসবে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে। বিগত অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে তা আরও ২৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে এনবিআর। বিগত অর্থবছরে ১১ মাসে ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের সব স্তরে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে আসবে ৬ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ভ্যাট। সিগারেটের তিন স্তরে সম্পূরক শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে মোবাইল ফোন ও সেবার বিপরীতেও। মোবাইল ফোনের টকটাইম ও সিম বিক্রি থেকে বাড়তি ভ্যাট আসবে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। দেশীয় এসি ও ফ্রিজের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে এ খাত থেকে আসবে ৪০০ কোটি টাকার ভ্যাট। কোমল পানীয়, কার্বনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, আমসত্ত্বের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এসব থেকে আসবে বাড়তি ২০০ কোটি টাকা। বাড়ানো হয়েছে আইসক্রিমের শুল্ক, যা থেকে ৫০ কোটি টাকা আসবে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী ইটের ভ্যাট ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা করা হয়েছে। এ খাত থেকে আসবে ৫০ কোটি টাকা। ট্যুর অপারেটর, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্ক, সিকিউরিটি সার্ভিস, লটারির টিকিট বিক্রয়কারী সেবাসহ এ ধরনের ১১ আইটেমে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হয়েছে। এসব থেকে আসবে বাড়তি ২০০ কোটি টাকা। ব্যাংকে জমা আবগারি শুল্কের বিভিন্ন স্তরে বাড়ানো হয়েছে কর। সেখান থেকে আসবে ২ হাজার কোটি টাকা। এভাবে বাড়তি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের ছক বানিয়েছে এনবিআর। এছাড়া মেট্রোরেল থেকেও বড় অঙ্কের ভ্যাট সংগ্রহের কথা ভাবা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকার সিটি করপোরেশন ও নারায়ণগঞ্জ শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ২২ লাখ ৬১ হাজার। এনবিআর সংশ্লিষ্টদের দাবি, করজালের বাইরে আছেন অন্তত ৬০ শতাংশ বিদ্যুতের গ্রাহক। যাদের একটা বড় অংশই বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক। বাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও আয়কর রিটার্ন বা আয়কর দেন না তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কর ফাঁকি রোধে এবার বাড়তি মনোযোগ দিয়েছে এনবিআর। ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিকদের ও সেবাগ্রহীতাদের করজালের আওতায় আনতে নতুন পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি অন্তত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমে আন্তঃসংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ আর ২০৪১ সালের মধ্যে শতভাগ আন্তঃসংযোগ স্থাপন করতে কাজও শুরু করেছে সংস্থাটি।
আয়কর কর্মকর্তাদের দাবি, সেবা নিলেও গ্রাহকরা প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এসব গ্রাহকের মনিটরিং ও তাদের কাছ থেকে কর আদায় করতে এনবিআর তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ১৬টি সংস্থার সঙ্গে থাকবে। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসি ও ডেসকো, বিআরটিএ, প্রধান আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রকের দফতর (সিসিআইঅ্যান্ডই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), বিডা, বেপজা, বেজা, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইবাস, বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, সিটি করপোরেশন, ভূমি মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসিকে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করের আওতা বাড়াতে গত কয়েক বছরে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টিআইএনের আওতায় আনা হয়েছে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি সেবার বিপরীতে রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যার ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে বর্তমানে টিআইএনধারীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে। আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী, ই-টিআইএন থাকলে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। তবে অনেকেই আয় গোপন ও কর পরিহারের উদ্দেশ্যে রিটার্ন দাখিল থেকে বিরত থাকেন। সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ব্যক্তি। করের আওতা বাড়াতে ও কর ফাঁকি বন্ধ করতে মোটরযান ও নৌযান নিবন্ধন, সব ধরনের ট্রেড লাইসেন্স এবং ঠিকাদার তালিকাভুক্তি কিংবা নবায়নে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। এসব সংস্থা রিটার্ন বাধ্যতামূলক করলে বড় অঙ্কের রাজস্ব আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রত্যক্ষ করের হিস্যা বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করার পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার হার কয়েক গুণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য আন্তঃসংযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। এর ফলে করজাল আরও বাড়বে এবং রাজস্ব আদায় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সেবা গ্রহীতাদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ থাকলে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় করা সহজ হবে। আমরা চাই গ্রাহকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর প্রদানে অংশগ্রহণ করুক। ওই কর্মকর্তার দাবি, শুধু বিদ্যুৎ, গ্যাস সিটি করপোরেশনের গ্রাহকদের ডাটাবেইসের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ করতে পারলে কয়েক কোটি নতুন করদাতা বেরিয়ে আসবেন। এতে আয়কর আদায়ও বাড়বে। বর্তমানে বিআরটিএ থেকে গাড়ির মালিকদের ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের ডাটা নিয়ে তথ্য যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছে আয়কর বিভাগ। যার সুফল আসতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কর কর্মকর্তারা।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, গত বছরের তুলনায় অর্থনীতি যে খুব ভালো হয়েছে সেটা বলা যাবে না। অর্থনীতি সার্বিক ধারায় ফেরেনি। এমন অবস্থায় নতুন অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মনে করেন ইউরোপ যুদ্ধসহ বৈশ্বিক মন্দা নতুন অর্থবছরে চলমান থাকতে পারে। এর ফলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, লক্ষমাত্রা অর্জনে যে ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন ছিল সেগুলো অনুপস্থিত। এনবিআরে প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা বলেন, রাজস্ব আদায়, জিডিপি, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক সূচকে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বাজেটে সেগুলো কোনটাই বাস্তব সম্মত নয়। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে অর্থনীতির বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এমন একটা সময় এবারের বাজেট পাস হলো যখন সামষ্টিক অর্থনীতি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সংকট তুলে ধরে তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট, নিম্নগামী রিজার্ভসহ নানান সংকটে ভুগছে অর্থনীতি। ফলে চাইলেই এ সময় রাজস্ব আহরণে এ বিপুল প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ