মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের জেরে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তবর্তী নাফ নদের ওপারে মংডু শহরে চলছে তুমুল লড়াই। গত মঙ্গলবার রাতভর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ সীমান্তের এপারে ভেসে এসেছে। এতে এপারের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার বিকেলে শুরু হওয়া এ লড়াই চলে গতকাল বুধবার পর্যন্ত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের জেরে নাফ নদের ওপারে মংডু শহরের নিকটবর্তী খায়েনখালী খালের পাশে রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা রয়েছে। এছাড়াও ওপারের সীমান্তে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সীমান্ত এলাকার লোকজন।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের কাউয়ারবিল ও পেরাংপুরু এলাকায় একের পর এক মর্টার শেল, ব্রাশফায়ার, রকেট লঞ্চার হামলায় বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি। এসময় জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ), অল বার্মা স্টুডেন্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, রোহিংগা স্যালভেশন আর্মি, বামার পিপলস লিবারেশন আর্মি, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, কারেনুনি আর্মি, কুকি ন্যাশনাল আর্মি, লাহু ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন, মন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রিটিক এলায়েন্স আর্মি, মিয়ানমার রয়াল ড্রাগন আর্মি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মিসহ ৩২টি মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। এ রকম বিকট শব্দ আর কখনও শোনেনি তারা। সারা রাত কেউ ঘুমাতে পারেনি। ওপারে মুহুর্মুহু গুলি, বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে বাড়িঘর। মর্টার শেল ও বিরামহীন গোলাগুলির শব্দে ঘুম নেই টেকনাফ সীমান্তে বাসিন্দাদের মাঝে। অনেকই নিরাপদে আশ্রয়ে ছুটছেন। সীমান্তজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
সূত্র আরও জানায়, টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এবং সাবরাংয়ের পূর্বে নাফ নদের ওপারে মংডু শহর। ওই মংডু শহরের নাফ নদ দিয়ে প্রবেশপথ খায়েনখালী খালটি। ওই খালের মোহনায় গত মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে রোহিঙ্গাবোঝাই কয়েকটি নৌকা দেখা গেছে। ওই সীমান্ত এলাকায় বিকেলের পর থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে থাকা এলাকা উদ্ধারের জন্য এমন গোলাগুলি বলে সীমান্ত এলাকার লোকজন মনে করছে। নৌকায় অপেক্ষমাণ রোহিঙ্গারা মংডু শহরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এদের বাংলাদেশে অনুপ্রেবশের চেষ্টার আশঙ্কা করছেন সীমান্ত এলাকার মানুষ।
টেকনাফ উপজেলার সীমান্ত এলাকার লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারের ওপার থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসতে শুরু করে, যা গতকাল বুধবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত থেমে থেমে অব্যাহত ছিল। এর আগে ১৫ জুন শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছয়টি ও রাত সাড়ে ১২টার দিকে থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। গত ১৬ জুন রোববার ও ১৭ জুন সোমবার (ঈদের দিন) আর কোনো শব্দ শোনা যায়নি। ঈদের পরদিন ১৮ জুন মঙ্গলবার বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। গত শুক্রবার থেকে মাঝরাতে মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণে ঘুম ভাঙল টেকনাফ সীমান্তে বাসিন্দাদের। গত শুক্রবার মাঝরাত থেকে শনিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। শনিবারের পর থেকে বিস্ফোরণের শব্দ বন্ধ ছিল। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার থেকে ফের শুরু হয় জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র আরাকান আর্মির সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
সাবরাং ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ শরিফ বলেন, গত মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাতভর বিস্ফোরণ এর আগে এমন তীব্র ছিল না। সীমান্ত এলাকার মানুষ পুরো রাত ঘুমহীন ছিল।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের গোলার শব্দে দ্বীপের সীমান্ত এলাকা কাঁপছে। আধঘণ্টা পরপর ওপারের গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আজকের গোলাগুলির শব্দ শাহপরীর দ্বীপ বাজারে পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। এতে সীমান্তে বসবাসকারী শিশু-নারীরা ভয়ভীতির মধ্যে আছেন।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান বলেন, গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে গতাকল বুধবার দুপুর পর্যন্ত মর্টারশেল ও গুলির শব্দে দ্বীপের ঘরবাড়িগুলো কেঁপে উঠেছে। এখনো কিছুক্ষণ পরপর শব্দ শুনতে পাচ্ছি, আমরা দ্বীপের লোকজন খুবই আতঙ্কে আছি।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা গৃহিণী আমিনা খাতুন বলেন, ফজরের নামাজের পর থেকে গোলাগুলির শব্দ শুনেছি। প্রথমে বজ্রপাতের শব্দ মনে করেছি। পরে নিশ্চিত হয়েছি মিয়ানমারে ফের যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
শাহপরীর দ্বীপের বাজারপাড়ার ব্যবসায়ী নুরুল আমিন জানান, মিয়ানমারে সংঘাতের পর এমন প্রচণ্ড বিকট শব্দ আর শোনা যায়নি। সীমান্তের ওপারে সকালের পর যুদ্ধবিমানেরও দেখা মিলেছে। ঘুমহীন রাত অতিবাহিত হওয়ার পর সীমান্তের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, দুই দিন বন্ধ থাকার পর আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। নাফ নদের ওপারে নৌকায় রোহিঙ্গাদেরও দেখা গেছে। অনুপ্রেবশ ঠেকাকে সীমান্ত এলাকার লোকজনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, মংডু শহরের খায়েনখালী খালটি নাফ নদের মোহনা। ওপারে মর্টার শেল, গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণের শব্দের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অবস্থান শোনা যাচ্ছে। তবে নাফ নদ অতিক্রম করে মিয়ানমারের লোকজনের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড। গোয়েন্দা নজরদারি, টহলও বাড়ানো হয়েছে।
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা গোলাগুলির শব্দের বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
* বিকট শব্দে এপারে সীমান্তে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক * রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের জেরে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা
মিয়ানমারে মুহুর্মুহু গুলি-বিস্ফোরণ কেঁপে উঠছে টেকনাফ সীমান্ত
- আপলোড সময় : ২৭-০৬-২০২৪ ১০:৩৮:১৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৭-০৬-২০২৪ ১০:৩৮:১৮ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ