বহিষ্কৃতদের ওপর আস্থা রেখেই নির্বাচনী মাঠে নেমেছে বিএনপি
- আপলোড সময় : ১৬-১১-২০২৫ ০৩:৫৩:২৮ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৬-১১-২০২৫ ০৩:৫৩:২৮ অপরাহ্ন
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা মোকাবিলা করছে বিএনপি। দীর্ঘ দমন-নিপীড়ন ও দলে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা পেরিয়ে এখন তাদের লক্ষ্য সংগঠন পুনর্গঠন ও নির্বাচনি মাঠে ঐক্যবদ্ধ থাকা। বহিষ্কৃতদের পুনর্বহাল করে তাদের প্রতি আস্থা রেখেই প্রার্থী করেছে দলটি।
দলীয় সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গ, অসদাচরণ বা মতবিরোধের দায়ে প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয় বিএনপি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আবারও তাদের প্রতিই বাড়ছে দলটির আস্থা। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দল এখন ‘ঐক্যের রাজনীতি’র পথে হাঁটছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে- গত কয়েকদিনে অন্তত ১৩ জন পদধারী নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন উপজেলা থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সক্রিয় মুখ। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা একাধিক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই শেষে বহিষ্কৃত নেতাদের প্রাথমিক সদস্যপদ পুনর্বহাল করা হলো। এর মধ্যে আছেন চট্টগ্রামের নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহের ফখর উদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, পিরোজপুরের রুহুল আমিন দুলাল, রংপুরের মোকাররম হোসেন সুজন, গাজীপুরের রাকিবুল উদ্দিন পাপ্পু প্রমুখ।
বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার হওয়া এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল, তারাও বিএনপিরই সন্তান। নির্বাচনের আগে সবাইকে এক ছাতার নিচে আনাই এখন অগ্রাধিকার। বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার ছাড়াও দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের কারণে কারণ দর্শানো নোটিশ পাওয়া নেতার প্রতিও আস্থা ফিরেছে দলে। নোটিশ ছাড়াও প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয় কিশোরগঞ্জের আলোচিত নেতা ফজলুর রহমানের। তবে কিশোরগঞ্জ-৪ আসন থেকে বিএনপি ঠিকই তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আস্থা রেখেছে পুরোনো নেতায়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে তার বক্তব্য নিয়ে কেন্দ্র অসন্তুষ্ট ছিল। তবে সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই তিনি ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।
দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক বলেন, বিএনপি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিয়েছে দল। কিন্তু এখন অনেকে নিজের ভুল শুধরে ফিরতে চাইছেন, দল যাচাই-বাছাই করে তাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে। এতে নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হবেন। বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে আলোচনায় আছে বহিষ্কার হয়েও মনোনয়ন পাওয়া নেতারা। ২৩৭ আসনের মধ্যে সাতজন বহিষ্কৃত নেতা এবার দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) রুহুল আমিন দুলাল, রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) মোকাররম হোসেন সুজন, রংপুর–২ (তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ) মো. আলী সরকার, সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা) আবদুর রউফ ও খুলনা-২ (সদর) নজরুল ইসলাম মঞ্জু।
গত ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দলের বহিষ্কৃত সাত নেতার বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। এর আওতায় মিরসরাইয়ের নুরুল আমিন চেয়ারম্যানের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সংগঠন পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে নেতৃত্ববিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে তিনি সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
ভালুকা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন বাচ্চু এবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল বিএনপি। দলের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, তিনি স্থানীয় কমিটি গঠনের সময় কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য করায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক রুহুল আমিন দুলালকে ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও রংপুর সিটি আংশিক) এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মোকাররম হোসেন সুজন। ২০২৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় তিনি বহিষ্কৃত হন। সুজন দলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
রংপুর-২ (তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ) এ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে মো. আলী সরকারকে। তিনি ২০০১ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, পরে বিএনপিতে যোগ দেন। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় একসময় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও গত ২৪ অক্টোবর তাকে পুনর্বহাল করে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা) দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বহিষ্কৃত সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রউফ এবার বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন।
সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে আলিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী সরকারের সময় প্রার্থী হওয়ায় কেন্দ্রীয় বিএনপি তাকে বহিষ্কার করে। পরে ২৩ এপ্রিল আলিপুর চেকপোস্ট মাদরাসা আয়োজিত মাহফিলে ইসলামি বক্তা কবির বিন সামাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনায় আলোচনায় আসেন তিনি। ওই ঘটনায় স্থানীয় আলেম সমাজ তার গ্রেফতার দাবি জানায়। পরদিন জেলা বিএনপি বিবৃতিতে স্পষ্ট করে জানায়, আবদুর রউফ বিএনপির কেউ নন। তার বহিষ্কারাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বহাল।
খুলনা-২ (সদর) ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর খুলনা জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন নিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে আপত্তি তোলায় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবুও ৩ নভেম্বর ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় তাকেই খুলনা-২ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তিনি দলের মহানগর সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্যও ছিলেন। সাত হাজারের বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু অপরিহার্য। শৃঙ্খলা দুর্বলতা নয়—এটাই আমাদের শক্তি। আমরা যেমনভাবে ক্ষমতাসীনদের কাছে সততার মানদণ্ড দাবি করি, তেমনভাবেই নিজেদেরও সেই মানদণ্ডে দাঁড় করাই। এভাবেই তরুণদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দীর্ঘদিন দলের জন্য কাজ করা, কিন্তু সামান্য অভিযোগে বহিষ্কৃত অনেক নেতাকে দল বিবেচনায় নিয়েছে। তাদের জনপ্রিয়তা ও ত্যাগের মূল্যায়ন করা হয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার