দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় প্রশাসনের রদবদলের অংশ হিসাবে একদিনে ২৩ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই আদেশ জারি করা হয়। এনিয়ে প্রশাসন তোলপাড়। অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ পদায়নই হয়েছে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে। এতে প্রশাসনের ভেতরে ক্ষোভের পাশাপাশি নিরপেক্ষতা ও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। মাঠ প্রশাসনে ঝুঁকি ও আস্থাহীনতার আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচনের আগে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক পদে এই পদায়নকে অনেকেই দেখছেন ‘নির্বাচনী মাঠ দখলের কৌশল’ হিসেবে। আর এ কারণে জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে জনপ্রশাসনের বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না বরং নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা, বর্তমানে অন্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, এমন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সামনে নির্বাচন, এই সময়ে মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব পেয়েছেন আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী অন্তত ১০ থেকে ১২ জন কর্মকর্তা।
পাশাপাশি, মাঠ প্রশাসনে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনজন ইকনোমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া অভিজ্ঞতা নাই বললে চলে এমন অযোগ্যদের ডিসি হিসেবে নিয়োগ হয়েছে। এতে একদিকে যেমন নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসনে বড় ঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে, তেমনই যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বঞ্চনার ভার আরও বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।
সামাজিক মাধ্যমে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান দেয়া ভিডিও ভাইরাল হওয়া আজাদ জাহানকে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করেছে সরকার। এর আগে তিনি ভোলার জেলা প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ এলাকায় শত একর জমিতে মৎস্য ঘের তৈরির অভিযোগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও তাকে নির্বাচনকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা গাজীপুরের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ায় প্রশাসনের ভেতরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
একইভাবে, সামাজিক মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের ছবি ও বার্তা শেয়ার করা উপসচিব আফসানা বিলকিসকে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, এমনকি টিউলিপ রেজওয়ানার ছবিও নিজের ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও এমন দলীয় সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ্যে আনায় প্রশাসনের ভেতর সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে, নড়াইলের সাবেক ডিসি শারমিন আক্তার জাহানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি করা হয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতির পরই তিনি ও কিছু আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শপথ’ নেন। তার বিরুদ্ধে নড়াইলের ডিসি থাকাকালীন আর্থিক অনিয়ম ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ইস্যুর অভিযোগও রয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে।
সাইফুল ইসলাম আওয়ামী শাসনামলে অর্থ বিভাগ, বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, একই জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে কাজ করেছেন। আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা ফেনীর জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেই এক আওয়ামী লীগ নেতার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। তার এই পদায়ন নিয়েও উঠেছে নানা বিতর্ক।
এছাড়া ইকোনমিক ক্যাডারের অন্তত তিন কর্মকর্তা যাদের মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা সীমিত তাদেরও জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ময়মনসিংহের নতুন ডিসি সাইফুর রহমান ও মানিকগঞ্জের ডিসি নাজমুন আরা সুলতানা। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তাদের পদায়ন প্রশ্ন তুলছে দক্ষ ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে।
একইভাবে, আওয়ামী ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বাগেরহাটের সাবেক ডিসি আহমেদ কামরুল হাসানকে নোয়াখালীর ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তারও মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা না থাকলেও দুই জেলার ডিসি পদে পরপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বিতর্কিত ২০১৪ সালের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার (এআরও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ ও লুৎফুন নাহারকেও যথাক্রমে বরগুনা ও মেহেরপুরের ডিসি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা ও নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোখলেসুর রহমানের সময় থেকেই ডিসি নিয়োগ নিয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারি ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ চলে আসছে। তখন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। সেই বিতর্ক এখন নতুন আঙ্গিকে আবারও ফিরে এসেছে, বিশেষ করে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে।
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আউয়াল মজুমদার গণমাধ্যমে বলেন, ‘জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দিলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয় এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ। নির্বাচনকালীন সময়ে ডিসিরা মাঠ প্রশাসনের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তাদের নিরপেক্ষ আচরণের ওপরই নির্ভর করে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও শান্তি। তিনি আরও বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এখনই এ ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করা উচিত। অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার না দিলে প্রশাসনের ভেতর বিভাজন আরও গভীর হবে, যা রাষ্ট্রীয় সেবার মানকেও ক্ষুণ্ন করবে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞাকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে বদলি করা হয়েছে। অন্যদিকে জনবিভাগের উপসচিব মো. রায়হান কবিরকে নারায়ণগঞ্জের নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিটিএস) পরিচালক (উপসচিব) এসএম মেহেদী হাসানকে লক্ষ্মীপুরে, পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব সৈয়দা নুরমহল আশরাফীকে মুন্সীগঞ্জে, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুর রহমানকে নেত্রকোণায়, অর্থ বিভাগের উপসচিব মো. শাহাদাত হোসেন মাসুদকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক (উপসচিব) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে নওগাঁতে, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আনোয়ার সাদাতকে খাগড়াছড়িতে এবং রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মু. রেজা হাসানকে কুমিল্লার ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। নতুন ডিসি পাওয়া অন্য জেলাগুলো হল- ঢাকা, পাবনা, রংপুর, যশোর, মেহেরপুর, নোয়াখালী, গাজীপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, মাদারীপুর, মৌলভীবাজার, বরিশাল, বরগুনা ও রাঙামাটিতে নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছে সরকার। জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে, নির্বাচনকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিতে কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই মাত্র তিন ঘণ্টার নোটিশে বিসিএস ২৫ ও ২৭ ব্যাচের ১৫ জন কর্মকর্তাকে তলব করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ডিসি ফিটলিস্টের সাক্ষাৎকারের নামে জারি করা নোটিশে বলা হয়েছিল, ‘কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ব্যতীত অনুপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়।’ বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সাক্ষাৎকারের জন্য তলব করা কর্মকর্তাদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অতীতে এ ধরনের নজির না থাকায় এ নিয়ে প্রশাসনে চলছে তোলপাড়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র বলছে, কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় তলব করা ১৫ জনের মধ্যে দুজন সাক্ষাৎকারে অনুপস্থিত ছিলেন। বাকি ১৩ জন অংশ নিলেও প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় না পাওয়ায় ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বাধ্য হয়ে সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ছিলেন আতঙ্কিত ও অসহায়।
কারণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-১-এর উপসচিব আমিনুল ইসলাম সই করা আদেশে বলা হয়েছিল, ‘কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ব্যতীত অনুপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়।’ এ কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
গত বুধবার সন্ধ্যায় এই দুই ব্যাচ থেকে ১৫ জনকে ডিসি নিয়োগের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তাঁরা হলেন-বিসিএস ২৫তম ব্যাচের নূরুল করিম ভুঁইয়া, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বকাউল, জালাল উদ্দীন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহেদ মোস্তফা ও মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন। ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন রেজাউল করিম, মোহাম্মদ এনামুল আহসান, মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলম হোসেন, হুরে জান্নাত, মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান মোল্লা, আবদুল্লাহ আল মামুন, মোহাম্মদ মোবাশশেরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম।
এদিকে নতুন করে ডিসি পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট তৈরির এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে প্রশাসনে। ডিসি পদায়নে যেসব কর্মকর্তাকে ডাকা হচ্ছে, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
প্রশাসনে তোলপাড়
নির্বাচনকালীন ডিসি নিয়োগ
- আপলোড সময় : ১৫-১১-২০২৫ ০৫:৪৮:৩১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-১১-২০২৫ ০৫:৪৮:৩১ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার