
স্থায়ী সমস্যা চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার জট


চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কনটেইনার জট যেন একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি পণ্য এখানে ওঠানামা করে। অথচ বন্দরের ধারণক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা সীমাবদ্ধতার কারণে কনটেইনার জট দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বর্তমানে বন্দরে প্রায় ১০ হাজার নিলামযোগ্য কনটেইনার বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি এক দশকের পুরোনো, যেগুলো ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে জমে আছে। বাকি সাড়ে চার হাজার কনটেইনারও বিভিন্ন সময়ে জমে থেকে জায়গা দখল করে আছে। এসব কনটেইনারে রয়েছে মেশিনারিজ, ফেব্রিক্স, সুতা, কেমিক্যালসহ নানা ধরনের পণ্য। অনেক কনটেইনারে মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক পদার্থ থাকায় বন্দরের নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ একাধিকবার কাস্টমসকে চিঠি দিয়ে দ্রুত নিলাম বা ধ্বংস কার্যক্রম সম্পন্ন করার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু মামলা, প্রশাসনিক জটিলতা, দরদাতার অনাগ্রহ এবং নিলাম প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতা ৫৯ হাজার কনটেইনার হলেও প্রতিদিন গড়ে ৪২ থেকে ৪৫ হাজার কনটেইনার থাকে। এর মধ্যে নিলামযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ায় কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা এসব কনটেইনারের কারণে নতুন কনটেইনার খালাসে দেরি হচ্ছে। এতে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, আবার শিপিং লাইনগুলোও তাদের কনটেইনার ফেরত পাচ্ছে না। এদিকে, কনটেইনার জটের আরেকটি বড় কারণ হলো ট্রেন সংকট। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ইঞ্জিন ও ওয়াগন ঘাটতির কারণে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় চার-পাঁচটি ট্রেনের বদলে এক-দুটি ট্রেনও পাওয়া যাচ্ছে না। কখনও আবার একটিও ট্রেন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বন্দরের ডিপো থেকে রাজধানীর কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) যথাসময়ে কনটেইনার পাঠানো যাচ্ছে না। বন্দরের ইয়ার্ডে যেখানে ধারণক্ষমতা ৮৭৬টি, সেখানে জমে আছে দুই হাজারের বেশি কনটেইনার। বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজে আরও এক হাজার কনটেইনার খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দরের বড় একটি স্থান এসব কনটেইনার দখল করে রাখায় নতুন কনটেইনার খালাসে দেরি হচ্ছে। এতে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যার প্রভাব পড়বে বাজারে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা। এদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সমপ্রতি বিশেষ আদেশ জারি করে নিলাম প্রক্রিয়া দ্রুত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, নিলামযোগ্য পণ্য দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই প্রথম নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রির সুযোগ থাকবে। দুটি নিলামের পরও ক্রেতা না পাওয়া গেলে তৃতীয় নিলাম ছাড়াই ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সর্বোচ্চ অফারদাতার কাছে বিক্রির বিধান রাখা হয়েছে। যেসব পণ্য নিলামে বিক্রি সম্ভব নয়, সেগুলো ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয়করণের জন্য বিশেষায়িত সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা যাবে। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, নিলাম প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। এনবিআরের নতুন নির্দেশনা ইতিবাচক হলেও দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে সমস্যার সমাধান হবে না। নিলামে দেরি হলে পণ্য নষ্ট হয়, ক্রেতা পাওয়া যায় না, দামও কমে যায়। দ্রুত নিলাম সম্পন্ন করলে কাস্টমস ভালো দাম পাবে, শিপিং লাইনগুলোও তাদের কনটেইনার ফেরত পাবে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে কয়েকশ কনটেইনারের খালাস সম্পন্ন হয়েছে এবং আরও কয়েকটি বড় নিলাম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছ। তবে একটি নিলাম প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ করতে অন্তত দুই মাস সময় লাগে। এজন্য মাসে কয়েকটি নিলাম আয়োজন করা হলেও জট পুরোপুরি কাটছে না। এদিকে রেলসূত্র বলছে, ইঞ্জিন সংকট প্রকট হওয়ায় বন্দরের চাহিদামতো কনটেইনার পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি সম্পর্কে রেল ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত থাকলেও নতুন ইঞ্জিন ও ওয়াগন যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সংকট কাটবে না। সব মিলিয়ে, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট এখন বহুমাত্রিক সংকটে রূপ নিয়েছে। নিলামে ধীরগতি, প্রশাসনিক জটিলতা, রেলওয়ের সীমাবদ্ধতা এবং আমদানিকারকদের অনাগ্রহ মিলিয়ে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এর প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে আমদানি ব্যয়, বাজারদর ও সরবরাহ চেইনে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ