নানামুখী সংকটে থাকা সীমিত আয়ের মানুষের সক্ষমতা কমছে, মাস শেষে আয়ে পোষাচ্ছে না, সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে কখনও সখনও। সাধারণের জীবনের এই চিত্র সামগ্রিক অর্থনীতির প্রতিফলন বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিছু সূচকের নিম্নমুখী দশায়, অন্য সূচকগুলোর স্বস্তি উবে গেছে, যে কারণে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও কমছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার বিনিময় হার বাজারমুখী করা, সুদহার সীমা তুলে দেয়া ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মত নীতি নির্ধারণী বিষয়গুলোতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বড় পরিবর্তন ধাক্কা হয়ে দেখা দিয়েছে, যা নতুন করে চাপ তৈরি করেছে উত্তরণের পথে থাকা অর্থনীতিতে। তাদের পর্যবেক্ষণ, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণেই মূলত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার, এটিই এখন অর্থনীতির সূচকগুলোকে টেনে ধরছে, মূল অস্বস্তি তৈরি করছে। লাগামের বাইরে চলে যাওয়া এই মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার মধ্যেই বাজার ব্যবস্থায় নিবিড় তদারকি, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং অতি জরুরিভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
কোভিড-১৯ মহামারীর চাপ সামলে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সংকট ডেকে আনে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। ডলার, জ্বালানি তেল ও খাদ্য শস্যের দাম বাড়তে থাকে। ব্যয় বেড়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের। সেই ধাক্কা সামাল দিতে গত দুই বছর ধরে বড় চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক।
এ সময়কালে নিজস্ব চেষ্টার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাহিদা মেটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর সঙ্গে এক বছর আগে ঋণ চুক্তিতে যায় বাংলাদেশ। চুক্তিতে যাওয়ার আগে ও পড়ে চাপে থাকা অর্থনীতি সামাল দিতে নানামুখী সংস্কারের মধ্যে দিয়ে এখন যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সেই সংস্কারও অনেকটা চাপ তৈরি করছে সাধারণের উপর। জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে দিতে বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করতে গিয়ে এক লাফে তা পৌঁছে গেছে ১১৭ টাকায়। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপে আছে সরকার। এতে ডলারের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। এতে শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় বাড়ছে। আর মূল্যস্ফীতির চাপে সীমিত আয়ের মানুষ ধুঁকছে। ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা এখন পর্যন্ত কাজে আসেনি। এজন্য নীতি বাস্তবায়নের দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
বাজেটের আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো দীর্ঘ সময় ধরে থাকছে। সুদহার, বিনিময় হার ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব নীতি নেয়া হচ্ছে তা ব্যর্থ হচ্ছে। আর্থিক খাত আরও চাপে পড়েছে। খেলাপি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাত তারল্য সংকট থেকে বের হতে পারেনি।
তবে অর্থনীতির অন্য সূচকের মধ্যে রেমিটেন্স, রাজস্ব ও রফতানি আয় ওঠানামার মধ্য দিয়ে এখন কিছুটা স্বস্তিকর জায়গায় পৌঁছেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য ও আর্থিক হিসাবগুলোতে আগের মত খুবই অস্বস্তির জায়গা অনেকটা কমেছে। তবে এসবের বিপরীতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হারে ধীরগতি বজায় রয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি নাজুক হয়ে গেছে। চার বছর পরে সুদহারের সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিনিময়ে হারে ক্রলিং পেগ চালু করায় বেড়েছে ডলারের দাম। এ দুই সিদ্ধান্তে ব্যবসার খরচ অনেক বাড়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। বড় ধরনের নীতি পরিবর্তনের কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় চাপে থাকা অর্থনীতিতে আরেকটু চাপ বাড়ছে বলে মনে করে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, অর্থনীতি যে ঘুড়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল তা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সুদহার তুলে দিয়ে সার্কুলার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার ব্যবসায়ীদের গভর্নর বলেছেন, ১৪ শতাংশের মধ্যে সুদহার থাকবে। তাহলে তো দুই ধরনের বার্তা গেল অর্থনীতিতে। কাগজে কলমে নীতি থাকার পরও তাতে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। তাহলে ব্যবসায়িক সুরক্ষাটা কোথায় থাকল না। ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নেয়ার সক্ষমতা থাকল না। এভাবে নীতি বিরোধী বক্তব্য দিলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এ কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন হয়ে গেছে কঠিন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এ কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন হয়ে গেছে কঠিন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এমন পরিস্থিতিতে তা নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকিতে মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকর করার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। এটি যদি না হয়, তাহলে যতোই বলা হোক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা হবে না। তিনি বলেন, দোকানে তো পণ্য আছে। এর মানে সরবরাহের দিকটায় খুব সমস্যা নেই, কিন্তু দাম বাড়ছে। ভোক্তা অধিকার দিয়ে বাজার তদারকিতে সাফল্য আসবে না। খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নামতে হবে।
আমদানিতে ভোগ্যপণ্যের শুল্ক কমিয়ে আনলে দাম সহনীয় হবে মন্তব্য করে সালেহউদ্দিন বলেন, পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদ তেমন কোনো প্রণোদনা পায় না। কৃষি খাত হিসেবে তাদের প্রণোদনা বাড়াতে হবে। এজন্য আইএমএফের কথায় সারে ও কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো যাবে না, এখানে যৌক্তিক হারে দিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতির রেমিটেন্স, রপ্তানি ও রাজস্ব আদায় সূচক কিছুটা স্বস্তিতে আছে। অন্য কোনো সূচকে ভালো অবস্থানে নেই। তবে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়ানো যেত। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত লাগবে।
রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত আমাদের এখনো ৭ দশমিক ৬ শতাংশের ঘরে। কর ছাড় ও কর সুবিধা দেয়া বন্ধ করতে হবে। কিছু খাতে কর ছাড় যৌক্তিক পর্যায় নামিয়ে আনতে হবে। কর ফাঁকিবাজদের ধরার তাগাদা দিয়ে তিনি বলেন, এনবিআরের বর্তমান কাঠামোতে শুধু লক্ষ্যমাত্রা দিলে হবে না। তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হয়রানিমুক্ত পরিবেশ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এনবিআরকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ তার।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, গত দুই বছর ধরে তো দুটি যুদ্ধ চলছে বিশ্বে, ইউক্রেন-রাশিয়ার পরে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের। রিজার্ভ একটু সংকটে থাকায় আমদানি তো ব্যবসায়ীরা যা চাচ্ছে তা করতে পারছে না। নতুন বিনিয়োগ চাইলেও বেশির ভাগ করতে পারেনি। কারখানার বর্তমান সক্ষমতাই ব্যবহার করা যাচ্ছে না, সেখানে নতুন বিনিয়োগ তো হবে না। আমরা আশা করছি সমস্যা কেটে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, তারাও খোঁজখবর রাখছে। রিজার্ভ একটু বাড়লে তখন সবই হবে। রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আরও আনতে হবে। রফতানি বৈচিত্রমুখী করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এখানেও ভালো কিছু হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

নানামুখী সংকটে সীমিত আয়ের মানুষ, কমছে সক্ষমতা
- আপলোড সময় : ০৫-০৬-২০২৪ ০২:৩৫:২৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৫-০৬-২০২৪ ০২:৩৫:৫৯ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ