ঢাকা , রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫ , ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
এই সরকার দিয়ে কোনো অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়-ডা. তাহের লাখো মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে যারা ধর্মের নামে রাজনীতির ব্যবসা করে, তাদের হাতে নারীরা নির্যাতিত-সালাহউদ্দিন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না-প্রধান উপদেষ্টা নারীদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়নের চিন্তা করলে ভুল হবে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকালীন ডিসি নিয়োগ পুলিশ দেখে ফেলে যাওয়া প্রাইভেটকারে মিললো এক লাখ পিস ইয়াবা তিন মাসে আয়ে প্রবৃদ্ধি তবুও তিতাসের লোকসান ২৪৯ কোটি টাকা প্রেমিকাকে ভিডিও কলে রেখেই তরুণের আত্মহত্যা দুই দশকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা আটগুণ বৃদ্ধি মুন্সিগঞ্জের ভাষানচর বালুমহল ইজারা ঘিরে অভিযোগ, হয়রানি বন্ধে তদন্তের দাবি কৃষি গুচ্ছ ভর্তির আবেদন শুরু ২৫ নভেম্বর, পরীক্ষা ৩ জানুয়ারি ভয়াবহ দুর্ভোগ হানিফ ফ্লাইওভারে! যৌনাচারের অভিযোগে ঢাবি শিক্ষক গ্রেফতার ইসলামী ব্যাংক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্বাচনের আগে গণভোট চায় ৮ দল আমি পাশে না দাঁড়ালে গ্রামীণ ব্যাংকের অনেক স্থাপনা থাকতো না-কাদের সিদ্দিকী স্কুলে ভর্তিতে কোটা নিয়ে আপত্তি অভিভাবকদের দেশে দ্রুত কমছে খাদ্যের মজুত ট্রাভেল এজেন্সি অধ্যাদেশ-২০২৫ বাতিলের দাবি
ঝুঁকিপূর্ণ জনবহুল ঢাকায় আতঙ্কের নাম আগুন

ঢাকা এখনও বোমা’র শহর

  • আপলোড সময় : ১৫-১০-২০২৫ ০৮:১৩:২১ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৫-১০-২০২৫ ০৮:১৩:২১ অপরাহ্ন
ঢাকা এখনও বোমা’র শহর
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে গতকাল মঙ্গলবার সকালে গার্মেন্টস ও কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুনে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছেন। এ ঘটনায় অনেকই অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। গুদামটিতে ব্লিচিং পাউডার, পলিথিন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ দাহ্য পদার্থের মজুত থাকায় অগ্নিকাণ্ডের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগেও টঙ্গীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একইভাবে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। বনানীর বহুতল ভবন ফারুক-রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনে ২৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বেইলি রোডে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সমান্তরালে রয়েছে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন। একদিকে ঘনবসতি, অন্যদিকে রয়েছে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ, বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্যের গুদাম ও কারখানা এবং চলাচলে রাস্তার অপর্যাপ্ততা, যা জননিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীতে অনেক আবাসিক ভবনেই বিপজ্জনকভাবে রাসায়নিক দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থের ব্যবসা জীবনের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর লালবাগ, চকবাজার, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড ও মিরপুর এলাকায় বসতবাড়িসহ অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গোডাউন করে রাখা হয় কেমিক্যাল। আর এসব কেমিক্যাল লোড করা হয় গভীর রাতে। কয়েকজন ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদকের কাছে গোডাউন থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা বলেন, ছোট ব্যবসায়ী বলে তাদের কোনও গোডাউন নেই। দোকানে যতটুকু ধরে ততটুকু মাল রাখেন তারা। অর্ডার পেলে মাল আনেন অথবা বড় দোকান থেকে ব্যবস্থা করেন। তবে বসতবাড়িসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গোডাউন থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও সেগুলো বড় দোকানদারদের বলে দাবি তাদের।
এ বিষয়ে কথা বলা হয় রূপসা কেমিক্যালের ম্যানেজার হামিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, দোকান বড় বা ছোট বিষয় না, গোডাউন সবারই আছে। পুরান ঢাকায় সব বাড়ির নিচেই কমবেশি গোডাউন আছে। তবে এখন কিছু গোডাউন কেরানীগঞ্জে নেওয়া হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে। গোডাউন থাকার সত্যতা মেলে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, দিনের এখানে মাল লোড হয় না, রাতে কেমিক্যাল আসে। তারাই গোডাউনে কেমিক্যালের ড্রামগুলো নিয়ে রাখেন। শ্রমিক জামাল হোসেন বলেন, গভীর রাতে গাড়ি এলে আমাদের ডাকে। প্রতিরাতেই গাড়ি আসে। আমরা মাল গাড়ি থেকে নিয়ে গোডাউনে দিই। এখন বাড়ির নিচে না দোকানের নিচে গোডাউন এটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। আর এদিকে বাড়ির নিচে ছাড়া গোডাউন কোথায় পাবেন। নতুন বাড়িগুলোতে গোডাউন নেই। পুরাতন সব বাড়ির নিচে গোডাউন আছে।
২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ১২৪ তাজা প্রাণ, আর ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১ জন। এই দুই ঘটনার পরই গোডাউনগুলো স্থানান্তর করার উদ্যোগ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। তবে অজানা কারণে এত বছর পার হলেও স্থানান্তরের জন্য স্থায়ী প্রকল্প চালু করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা শিথিলতার কোনো ফাঁক গলে আগুনের লেলিহান শিখা কোথায় ছড়িয়ে পড়বে তা আগে থেকে অনুমান করার উপায় নেই। তবে সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও তার ইত্যাদি ব্যবহারের সময় পণ্যমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বাড়িঘর ও কলকারখানায় অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি এলাকায় পানি সংগ্রহের পর্যাপ্ত উৎস থাকতে হবে। কোথাও আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে জানালেও প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে বড় অগ্নিকাণ্ড সবার দৃষ্টি কাড়লেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আগুনের ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, এই শহর ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। আগুনের মতো এ ধরনের দুর্যোগ, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা আমাদের নেই। আইন না মেনে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলছে সুউচ্চ ভবন। কিন্তু সেসব ভবনের আগুন নেভানোর মতো যথেষ্ট সরঞ্জাম থাকছে না। বাসিন্দাদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভবন মালিকদের কাছে সব সময়ই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ১৯ হাজার ৬৪২টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ড হয়। এতে কমপক্ষে ১৩০ জন নিহত ও ৬৬৪ জন আহত হয়। এসব অগ্নিকাণ্ডে সম্পদের ক্ষতি হয় ৪৩০ কোটি টাকার মতো। বেশিরভাগ আগুনের সূত্রপাত বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, চুলার আগুন, গ্যাস সিলিন্ডার, ছুড়ে দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেট ইত্যাদি থেকে। প্রতিবছর গড়ে ১৯ হাজার আগুনের ঘটনা ঘটে। গত ১০ বছরে সারা দেশে ১ লাখ ৫০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকাণ্ড হয়। এতে প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজারের বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে। গত ১০ বছরে শিল্পে অগ্নিদুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি হয় ২০১৫ সালে। ওই বছর এক হাজার ১৩টি আগুনের ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৬৪৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে দেশের সাত বিভাগে ২৫৮টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ৩২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ৯৬১টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৭৩ কোটি টাকা। শিল্পে অগ্নিদুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির প্রায় ২৫ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত ও শপিংমল সেক্টরে ১০ শতাংশের মতো ক্ষতি হয়। গত ১০ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় ২ হাজার ২০০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড হলেও একটিরও অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই এসব অগ্নিকাণ্ডে কাউকে দায়ীও করা যায়নি। এর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার মতো।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২৯টি। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয় ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার। পরের বছর অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩-এ। ১২ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি এতে ক্ষতি হয় ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার। ২০১৫ সালে রাজধানীর বস্তিগুলোয় ৪৭টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় তিনজন। আর ক্ষয়ক্ষতি হয় ১ কোটি ১১ লাখ টাকার। পরের বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কিছুটা কমে ২৭ এ দাঁড়ায়। এতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নিহত হয় একজন। ২০১৭ সালে রাজধানীর বস্তিগুলোয় ৩২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় একজন। পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা, গার্মেন্টসহ শ্রমঘন শিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরির কারণে রাজধানী জুড়েই ঘিঞ্জি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনা নির্মাণে মালিকপক্ষ নিজেদের কোনো জায়গা না ছাড়ায় গায়ে গায়ে লেগে থাকছে ভবনগুলো। ফলে, দুর্ঘটনায় উদ্ধারকার্য চালানো কিংবা ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জাম পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। বনানীর অগ্নিকাণ্ডেও পুরান ঢাকার মতোই একই ঘটনা ঘটেছে। ফলে উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় আনুমানিক ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা কেমিক্যাল পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজারই রয়েছে বাসাবাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদাম অবৈধ। ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ২০০ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবসা চলে সেসব গুদামে। এসব গোডাউনে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল, টলুইনের মতো দাহ্য পদার্থ। ফলে যেকোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নগর পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহারিয়ার আমিন বলেন, পুরান ঢাকার সমস্যা হচ্ছে আমরা আমাদের বাসস্থানকে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছি। কিন্তু কালের আবর্তনে ব্যবসাকেন্দ্রকে আমরা স্থানান্তর করিনি। বড় কোনও দুর্ঘটনা হলেই আমরা আইন করি কিন্তু প্রয়োগ করি না। কিন্তু পুরান ঢাকার মতো জনবহুল জায়গায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আবারও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর জন্য সরকার বা যারা দায়িত্বে আছেন তাদের অতিসত্বর গোডাউনগুলো স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স