* সেপ্টেম্বরে ৫০৪ সড়ক দুর্ঘটনা * ৫০২ জনের মৃত্যু * আহত ৯৬৪
সড়কে মৃত্যুর মিছিল
- আপলোড সময় : ১৫-১০-২০২৫ ১১:৩২:৪৬ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-১০-২০২৫ ১১:৩২:৪৬ পূর্বাহ্ন
গেল সেপ্টেম্বরে দেশের গণমাধ্যমে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত এবং ৯৬৪ জন আহতের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রেলপথে ৫০টি দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত ও তিনজন আহতের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বলে এক বার্তায় জানিয়েছেন সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তথ্যমতে, নৌপথে ১৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ জন, আহত ১৫ জন এবং তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৫৬৭টি দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত এবং ৯৮২ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে ১৯১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৯৯ জন নিহত ও ১৮৮ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৭.৮৯ শতাংশ এবং নিহতের ৩৯.৬৪ শতাংশ ও আহতের ১৯.৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে ১২৬টি। এতে ১২২ জন নিহত ও ২১৬ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বরিশাল বিভাগে ২২টি। এসব ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়েছেন। সংগঠনটি বলছেন, বর্তমান সরকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়ার উদ্যোগের পরিকল্পনায় গলদ থাকায় এই যানকে নিবন্ধন দেওয়া হলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা দিগুণ হবে। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথের দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ৯ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১৩৩ জন চালক, ১০৬ জন পথচারী, ২৬ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬৫ জন শিক্ষার্থী, ৮ জন শিক্ষক, ৮৮ জন নারী, ৫৪ জন শিশু, দুজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন আইনজীবী, একজন সাংবাদিক, চিকিৎসক একজন এবং ১২ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে। এদের মধ্যে নিহত হয়েছেন-পাঁচজন পুলিশ সদস্য, একজন সেনা সদস্য, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন আইনজীবী, একজন চিকিৎসক, ১২৬ জন বিভিন্ন পরিবহনের চালক, ১০২ জন পথচারী, ৬৭ জন নারী, ৪৯ জন শিশু, ৫৬ জন শিক্ষার্থী, আটজন পরিবহন শ্রমিক, আটজন শিক্ষক ও সাতজন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। এই সময় সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত ৭৭২টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এতে দেখা যায়, ২৯.০১ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২২.০২ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি, ১৬.৫৮ শতাংশ বাস, ১২.১৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭.৩৮ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৭.২৫ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা, ৫.৫৬ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস। সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪৮.৮০ শতাংশ গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২৮.৫৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৭.৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ৩.৭৬ শতাংশ বিবিধ কারণে, চাকায় ওড়না পেছিয়ে ০.৩৯ শতাংশ, এবং ০.৫৯ ট্রেন-যানবাহনের সংঘর্ষে ঘটেছে। দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪৫.০৩ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২৪ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৫.৩৯ শতাংশ ফিডার রোডে হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩.৯৬ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০.৯৯ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৫৯ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে। ১. বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশের সড়কের মাঝে ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি, এসব গর্তের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। ২. সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন-করিমন অবাধে চলাচল। ৩. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা। ৪. সড়কে মিডিয়ান বা রোড ডিভাইডার না থাকা, সড়কে গাছপালায় অন্ধবাঁকের সৃষ্টি। ৫. মহাসড়কের নির্মাণ ক্রটি, যানবাহনের ক্রটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা। ৬. উল্টোপথে যানবাহন, সড়কে চাদাঁবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন। ৭. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রীবহন। ৮. বেপরোয়া যানবাহন চালানো এবং বিরামহীন ও বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালানো।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সড়ক-মহাসড়ক জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা। ২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা। ৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান। ৪. গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কে ফুটপাতসহ সার্ভিস লেইনের ব্যবস্থা করা। ৫. সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা। ৬. মহাসড়কে ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা, রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা। ৭. সড়ক পরিবহন আইন উন্নত বিশ্বের আদলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করা। ৮. সারাদেশে উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওর্য়াক গড়ে তোলা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ৯. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা। ১০. মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহন ও দীর্ঘদিন যাবত ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্যাপ করার উদ্যোগ নেওয়া। ১১. ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী চালকের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভ্যাট ও আয়কর অব্যাহতি দেওয়া। ১২. মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি ও নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ করা।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) মহাসচিব লিটন এরশাদ মনে করেন, আমরা মনে করি সড়কে মানুষের জীবন বাঁচানোর দাবী শুধুমাত্র আমাদের নয়, এটি সর্বোচ্চমহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই অনুধাবন করেন। আমরা বিশ্বাস করি সম্মিলিত উদ্যোগ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেশের সড়ক দুঘটনা হ্রাস করার মাধ্যমে দুর্ঘটনাজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি (জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ) কমানোর পথ সুগম করবে যার মাধ্যমে এসডিজির ৩.৬ এবং ১১.২ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বাংলাদেশ অনেক দুর এগিয়ে যাবে। তবে আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দীর্ঘ জার্নিতে উপলব্ধি করেছি এসডিজির ৩.৬ এবং ১১.২ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দেশের অর্থনৈতিক এই সমৃদ্ধি অর্জনে সকল মতপক্ষের রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা জরুরী। এজন্য সরকারকে সকল রাজনৈতিক দলকে আস্থায় আনতে হবে এবং আমাদের জোর দাবী রাজনৈতিক দলগুলোও যেন তাদের আগামী নির্বাচনী ইশতিহারে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভূক্ত করে জাতির সামনে তুলে ধরে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি সড়ক দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা বহুমাত্রিক হওয়ায় সরকারের একার পক্ষে তা নিরসন করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কার্যকর উদ্যোগ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এই আইনে কিছু কার্যকর দিক থাকলেও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে প্রচুর। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সড়ক দুর্ঘটনার আচরণগত পাঁচটি মূল ঝুঁকি যেমন অতিরিক্ত গতি, স্টান্ডার্ড হেলমেট ও সিটবেল্ট ব্যবহার না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, শিশুদের জন্য নিরাপদ আসনের অনুপস্থিতি বিবেচনায় রেখে সার্বিকভাবে সেইফ সিষ্টেম এপ্রোচ-এর আলোকে যথাযথ আইন ও বিধিমালা বাস্তবায়িত হলে সড়ক নিরাপদ হয়ে উঠবে। এইজন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র সড়ক নিরাপত্তা আইনের। আশার কথা সরকার এই বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। একটি কমিটি গঠন করেছেন সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরিতে, যা ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে। আমরা আশা করি অচিরেই একটা কার্যকর আইন প্রনয়ণ হবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। তিনি আরও বলেন, নিসচা মনে করে উন্নত দেশগুলো নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য সেইফ সিস্টেম এপ্রোচ তথা বহুমুখি পরিবহন ব্যবস্থা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনার আলোকে নিজেদের আইনী ও নীতি কাঠামো প্রণয়ন করে যথাযথ বাস্তবায়নে সুফল পেয়েছে। সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের উদ্দেশ্য হলো মানুষ বা সড়ক ব্যবহারকারী ভুল করলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা এমন হবে যার ফলে মানুষকে তার ভুলের সর্বোচ্চ মাসুল অর্থাৎ মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার যেন হতে না হয়। এক্ষেত্রে আমরা জোর দাবী জানাচ্ছি, বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় বাংলাদেশ রোড সেইফটি প্রকল্পে যে বরাদ্দ রয়েছে তা পুরোপুরি সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের কাজে ব্যবহার করা। যেন সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের আলোকে সড়কে মানুষের জীবনের মৃত্যু ঝুঁকি কমে। পাশাপাশি সড়কে মৃত্যু কমাতে নতুন আইনী কাঠামো প্রণয়নও এখন সময়ের দাবি। কারণ বাংলাদেশের সড়ক পথচারী তথা সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় প্রতিদিনই পথচারী তথা সড়ক ব্যবহারকারী শিকার হচ্ছেন দুর্ঘটনার। কিন্তু বর্তমান আইন বা নীতিকাঠামোতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার বিষয়টি উদ্বেগজনকভাবে অনুপস্থিত। তাই আপনাদের মাধ্যমে একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন আইন প্রণয়ণের যে কাজ চলছে তা দ্রুত এগিয়ে নিতে দাবি জানাচ্ছি। আমরা মনে করি এই আইন প্রণীত হলে এবং যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে যার মূল কেন্দ্রে থাকবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার