চারুকলায় বকুলতলার পর পুলিশের বাধার কারণে এবার পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতেও ‘শরৎ উৎসব ১৪৩২’ আয়োজন করতে পারেনি সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় উৎসবটি করার কথা থাকলেও, ‘অনেকের কাছ থেকে আপত্তি আসায়’ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আয়োজনে বাধা আসে। শেষ মুহূর্তে ‘গোলযোগ’ হওয়ার শঙ্কাকে কারণ দেখিয়ে চারুকলা কর্তৃপক্ষ ভেন্যু বরাদ্দ বাতিল করে, ফলে সেখানে উৎসবটি করা সম্ভব হয়নি। পরে আয়োজকরা উৎসবটি একই সময়ে গেন্ডারিয়ার কচিকাঁচার মেলার মাঠে আয়োজন করার ঘোষণা দেয়। সেখানে ‘অনুমতি না থাকার’ কথা জানিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে থেকে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে এই উৎসব আয়োজনে ১৯ বছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়লো বলে জানিয়েছেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
প্রায় দুই দশক ধরে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ‘শরৎ উৎসব আয়োজন করে থাকে ‘সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী’ নামে একটি সংগঠন। এবারো একই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও শেষ পর্যন্ত অনুমতি বাতিল করে দেয় চারুকলা অনুষদ।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনুমতি বাতিলের পর ওই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি পরে পুরানো ঢাকার গেন্ডারিয়ায় কচিকাঁচার মেলা স্কুলে আয়োজন করার ঘোষণা দেয়। সেখানেও ‘অনুমতি না থাকার’ কথা জানিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে থেকে অনুষ্ঠানটি না করতে বলা হয়।
পরে অবশ্য গেন্ডারিয়াতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন, শিশুদের চিত্রাঙ্কন এবং প্রয়াত সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের স্মৃতির প্রতি এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে আয়োজনটি করা হয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে।
শরৎ উৎসবের আয়োজক কমিটির অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা কিংবা গেন্ডারিয়ায় দুটি জায়গাতেই আয়োজক কমিটিকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। যে কারণে দীর্ঘ বছরের এই উৎসবটি তারা পালন করতে পারেনি।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরও তারা অনুষ্ঠানটি করেছেন, এবারও আমরা অনুমতি দিয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত অনেকের কাছ থেকে আপত্তি আসায় শুক্রবার এই অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে’।
চারুকলা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শনিবার এ নিয়ে জরুরি মিটিং ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীকেও ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে স্থগিত এই অনুষ্ঠানটি আবার হবে কী-না। প্রতি বছর বিভিন্ন ঋতুতে আলাদা আলাদা উৎসবের আয়োজনে হয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের বকুল তলায়।
এর মধ্যে শরৎ, বর্ষা কিংবা নবান্ন উৎসবগুলো আয়োজন করে থাকে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। প্রতি বছর দুর্গাপূজার এক সপ্তাহ আগে কিংবা এক সপ্তাহ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় এই উৎসবটি আয়োজন করে ওই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি।
এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি জানিয়েছে, গত বছর শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরও তারা একই সময় শরৎ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। তখনও কোনো বাধা আসেনি।
সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ১৯ বছর ধরে এই উৎসবটি পালন করে আসছি। কিন্তু এবার দুটি জায়গা থেকেই আমাদের ওপর বাধা এসেছে’। একই সঙ্গে তিনি জানান, তিনি আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন। তবুও কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিনের এই উৎসব আয়োজনটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
চারুকলা অনুষদে এই শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে বেশ কিছু উৎসবের উদাহরণ টেনে তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, মূলত সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যে কারণে কিছু ‘ভুঁইফোঁড়’ সংগঠন এই আয়োজনটি ‘ছিনতাই’ করতে চাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন মি. চৌধুরী।
ওয়ারী জোনের পুলিশের উপ-কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ বলেছেন, আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে সেখানে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করার কারণেই সেখানে বাধা এসেছে।
মানজার চৌধুরী আরও জানান, এবারও তারা নিয়ম মেনে চারুকলার বকুল তলার অনুষ্ঠান করার অনুমোদন নেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাদেরকে চারুকলা কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেখানে অনুষ্ঠানটি করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘যে উৎসব আমরা প্রায় ১৯ বছর ধরে করছি, হঠাৎ আমাদেরকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। প্রকৃতির বন্দনায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা ফ্যাসিবাদের প্রশ্ন কেন আসবে?’।
আগে থেকেই অনুমতি নেওয়ার পর হঠাৎ করে এই অনুষ্ঠান কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো, এমন প্রশ্নে চারুকলা অনুষদও খুব একটা সদুত্তর দিতে পারেনি।
অনুষ্ঠানটির অনুমতি বাতিলের কারণ জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা তো অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা পক্ষ কালচারাল ফ্যাসিবাদ ট্যাগ দেওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে’।
তবে তিনি এটিও জানিয়েছেন যে, স্থগিত অনুষ্ঠানটি আবার আয়োজন করা যায় কী-না এটি নিয়ে শনিবার তারা সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসবেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অনুষ্ঠানটির অনুমতি বাতিল করা হয়, তখন বিকল্প হিসেবে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়া কচিকাঁচা মেলার মাঠ ও খেলাঘর আসরের দুইটি স্থানকে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে চিন্তা করে ওই শিল্পীগোষ্ঠী। পরে আয়োজকরা শুক্রবার সকাল সাতটার উৎসবটি গেন্ডারিয়ার কচিকাঁচার মেলার মাঠে আয়োজন করার ঘোষণা দেয়।
মি. চৌধুরী আরও বলছিলেন, ‘আমরা যখন অনেকটা বাধ্য হয়েই অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলাম। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা আসলো। বলা হলো, এখানে অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে থানায় অভিযোগ এসেছে। যে কারণে পুলিশ আমাদের বলেছে কচিকাঁচার মেলার মাঠেও আমরা অনুষ্ঠান করতে পারবো না’।
কারা থানায় এটি নিয়ে অভিযোগ দিয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে মি. চৌধুরী বলেন, ‘ওইখানে সাঈদ বারী নামে একজন সাংবাদিক নাকি পুলিশকে বলছে আমরা ফ্যাসিবাদের দোসর। যে কারণে সকাল থেকেই কচিকাঁচার মাঠের পাশে পুলিশ জড়ো হয়, আমাদের অনুষ্ঠানে বাধা দেয়’। কিন্তু সাঈদ বারী নামে ওই সাংবাদিকদের পরিচয় সম্পর্কে তিনি কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
আয়োজক কমিটি বলছে, এক পর্যায়ে গিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই কচিকাঁচার মেলার মাঠের এক পাশে জাতীয় সংগীত গেয়ে ও প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী ফরিদা পারভীনের স্মরণে এক মিনিটের নীরবতা পালন করেন তারা। একই সময়ে শিশু-কিশোরদের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল, সেটিও একটি কক্ষে করেন তারা।
সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যখন এখানে আয়োজন আনলাম, তখন আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলো- এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা আছে। তখন প্রতিবাদ স্বরূপ আমরা খুব ছোট করে অনুষ্ঠান করে চলে এসেছি’। তিনি জানান, ওই অনুষ্ঠানের সময় আশপাশে কয়েক স্তরে পুলিশ মোতায়েন ছিল।
কেন পুলিশ সেখানে বাধা দিয়েছে- এমন প্রশ্নে ওয়ারী জোনের পুলিশের উপ-কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘যে স্কুলে ওনার উৎসবটা তারা করতে চেয়েছিলেন, সেই মাঠে এই উৎসবটা করার জন্যও ওনারা কোনো অনুমতি নেননি। সেখানকার কর্তৃপক্ষও এই অনুষ্ঠানটা করতে দিতে চাচ্ছিলেন না। এখানে পুলিশের কোন ভূমিকা নাই’।
অনুষ্ঠানের আগের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফেসবুকে একটি পোস্টার ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কয়েকজনকে দেখা যায়। তাদের মধ্যে সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরীও ছিলেন। একই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানজার চৌধুরীকে ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়েও প্রচারণা করতে থাকে কেউ কেউ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

চারুকলার পর গেন্ডারিয়াতেও ‘শরৎ উৎসবে’ বাধা
- আপলোড সময় : ১১-১০-২০২৫ ১২:২১:৫৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১১-১০-২০২৫ ১২:২১:৫৬ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ