
রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব
বিএনপি চায় সংসদে জামায়াত গণভোটে
- আপলোড সময় : ০৯-১০-২০২৫ ০৩:৫০:৫৯ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৯-১০-২০২৫ ০৩:৫০:৫৯ অপরাহ্ন


* ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদে মনোনয়ন বাছাইয়ে কৌশলী বিএনপি
* নির্বাচনে ব্যাপক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জামায়াতে ইসলামী
* ক্লিন ইমেজের মুসলিম-অমুসলিমদের প্রার্থী করা হবে জামায়াতে
* শতাধিক আসনে জামায়াতের শক্ত অবস্থান
* কর্মীদের দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ, দূরত্বই থাকছে বিএনপির সঙ্গে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সবশেষে বৈঠকে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে একমত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দল। তবে সংস্কার প্রস্তাবে পিআর পদ্ধতিসহ বেশ কিছু ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। গণভোটেই এসব আপত্তির নিষ্পত্তি চায় জামায়াত। অন্যদিকে বিএনপি চায় সংসদ নির্বাচনের দলীয় ম্যান্ডেট অনুযায়ী এসব বিরোধের সমাধান। মোটাদাগে মৌলিক সংস্কারের মধ্যে উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান থাকতে পারবে না, রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। অন্যান্য দলেরও বিভিন্ন ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। অনিশ্চয়তা-সংশয় সত্ত্বেও দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ দলটি শেষ করে রেখেছে। এছাড়াও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। ইতোমধ্যে ২৯৮ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে তারা। দুটি আসনের মনোনয়ন আটকে আছে কিছু জটিলতায়। এ ছাড়া যেসব আসনে দলের শক্ত প্রার্থী নেই, সেসব আসনে এবার দলের বাইরের ক্লিন ইমেজের নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির লোক মনোনয়ন দেবে দলটি।
জামায়াতে ইসলামী বলছে, গণভোটেই নোট অব ডিসেন্টের (আপত্তি) নিষ্পত্তি চায় তারা। জুলাই সনদের যে বিষয়গুলোর ওপর বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট আছে সেগুলোর ওপর আলাদাভাবে জনগণের মতামত নিয়ে সেগুলো এখানে নিষ্পত্তি করতে চায় দলটি। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, যে-দল যেভাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে সেভাবেই জুলাই সনদের ওপর গণভোট হবে। এখানে নোট অব ডিসেন্টের ওপর আলাদাভাবে মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই। নোট অব ডিসেন্ট জনগণের সামনে উন্মুক্ত থাকবে, এরপর সংসদ নির্বাচনে যেই দল জনগণের ম্যান্ডেট পাবে সেই দল তাদের নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবে।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, এগুলো (নোট অব ডিসেন্ট) নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ কোনো দলেরটা তো বড় না, জনগণের মতটাই বড়। জামায়াতের এ নেতা বলেন, নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে আমাদের অবস্থান আইনে যা আছে তা। কোনোটা যদি গণভোটে পাস হয়ে যায় তাহলে সেটা বাস্তবায়ন হবে। দল হিসেবে কী বলছি, আমাদের তো নোট অব ডিসেন্ট আছে। আমার নোট অব ডিসেন্টে জনগণ যদি হ্যাঁ ভোট দেয় তাহলে একরকম, না ভোট দিলে আরেক রকম। অর্থাৎ গণভোটটাই হচ্ছে সুপ্রিম ল’। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জনগণ যদি আমার নোট ডিসেন্ট অ্যাকসেপ্ট না করে তাহলে আমার নোট অব ডিসেন্টের আর গুরুত্ব নেই, আইনি কোনো গুরুত্ব নেই। আর জনগণ যদি গ্রহণ করে তাহলে এর মধ্যেই সেটেল (সমাধান) হয়ে যাবে। তিনি বলেন, নোট অব ডিসেন্ট মানে কি? আমি দ্বিমত, দল হিসেবে। গণভোটে জনগণ যদি আপনার এটা অ্যাকসেপ্ট না করে তাহলে এটা বাতিল হয়ে গেলো। আর জনগণ অ্যাকসেপ্ট করলে আপনি টিকে গেছেন। বিষয়টা হলো আইনগতভাবে এটা। গণভোটে নোট অব ডিসেন্টের ওপর জনগণ থেকে কীভাবে মতামত নেওয়া হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এ নেতা বলেন, সেটা ঐকমত্য কমিশন করবে কোন প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করবে। জুলাই সনদে তো লেখা থাকবে নোট অব ডিসেন্ট কোনটা সেই অনুযায়ী জনগণ মত দিবে।
আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। ডিসেম্বরে তারা নির্বাচনের চূড়ান্ত তারিখ বা তফসিল ঘোষণা করবে। একটি সূত্রমতে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হতে পারে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি। সেই ভোটযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য জামায়াতের তৎপরতাও ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী ২৯৮ আসনে খসড়া প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। প্রার্থীরা যার যার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে অনেক আসনের প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে বলে জানা গেছে। কিছু আসনে বিতর্কিত প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নতুন প্রার্থী দেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে দলের রোকন নন, কিন্তু ক্লিন ইমেজ আছে, এমন মুসলিম অথবা অমুসলিম ব্যক্তিকেও দলটি এবার নমিনেশন দেবে। দলীয় সূত্র মতে, আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য অতীতের ধরাবাঁধা নিয়মে এবার পরিবর্তন আনবে জামায়াত। একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, এলাকায় গ্রহণযোগ্য, জাতীয়ভাবে পরিচিত কোনো মুখ প্রার্থী হতে চাইলে বিবেচনা করা হবে। আগ্রহ ও যোগ্যতা থাকলে অমুসলিম ব্যক্তিদেরও বিবেচনা করা হবে।
জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আসনে খসড়া প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে পোলিং এজেন্টদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কোন আসনে কারা পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন-সেসব খোঁজখবরও দলের পক্ষ থেকে রাখা হচ্ছে। অতীতের চেয়ে এবার দলটি সব বিষয়ে অনেক বেশি কৌশলী বলে কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। দলীয় সূত্রে জানা যায়, জামায়াত গত বছরের ডিসেম্বরে সারা দেশে প্রতিটি আসনে প্রথম পর্যায়ের জরিপ পরিচালনা করে। ওই জরিপের প্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
জনগণের মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে হামিদুর রহমান আযাদ আরও বলেন, যেগুলো (যেসব সংস্কার প্রস্তাব) সর্বসম্মত এটা একটা মত হবে, আরেকটা হলো নোট অব ডিসেন্ট আছে যেগুলো সেগুলো নিয়ে একটা মত নেওয়া হবে। জনগণ ঠিক করবে তারা কোনটা গ্রহণ করবে, কোনটা করবে না।
নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে বিএনপি অবস্থান জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, সংসদ নির্বাচনে যে দল জনগণের ম্যান্ডেট পাবে সে দল তাদের নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী কাজ করবে।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদ প্রণীত হবে, স্বাক্ষরিত হবে, অঙ্গীকারনামায় সবাই সই করবে, সেটা ওয়েবসাইটে যাবে, সব দলের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকবে, সরকার প্রকাশ করবে, নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে, জনগণ জানবে জুলাই সনদে কী আছে? তারপরেই দেবে। তিনি বলেন, যেগুলো নোট অব ডিসেন্ট আছে ওইটাও সনদে উল্লেখ আছে-যে সমস্ত দল ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক (নির্বাচনে) জনম্যান্ডেট পাবে সে সমস্ত দল তাদের নোট অব ডিসেন্ট অনুসারে যেতে পারবে। এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদে পিআরের কথা বলা আছে। কিন্তু সেই পিআরের গঠন প্রণালি সম্পর্কে আমাদের নোট অব ডিসেন্ট আছে, আরও কারও কারও নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেটা তো অঙ্গীকারনামায় থাকবে। যারা ম্যান্ডেট পাবে তারা তাদের মতো করে যাবে। কারণ জনগণ তো রায় দেবে জুলাই সনদের বিষয়ে। স্পেসিফিক কোনো একটা বিষয়ের ওপর না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে গণভোটের বিষয়ে একমত হয় সব রাজনৈতিক দল। তবে সংস্কার প্রস্তাবে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি), গণভোটের সময়, গণভোট আয়োজনে অধ্যাদেশ, নাকি সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হবে এসব নিয়ে এখনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা কখনোই পেশিশক্তি, টাকার প্রভাব বা পারিবারিক বিবেচনায় প্রার্থী মনোনয়ন দিইনি, ভবিষ্যতেও দেব না। মনোনয়নের ক্ষেত্রে আমরা যে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিই, সেটি হলো প্রার্থী যেন সংশ্লিষ্ট এলাকার সমস্যা সম্পর্কে জানেন, মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও সম্পৃক্ততা থাকে এবং ওই এলাকার জনগণের কল্যাণে কাজ করার সক্ষমতা রাখেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এমন একজন প্রার্থী, যার সঙ্গে এলাকার তরুণ, নারী, মুরুব্বি, ছাত্রছাত্রী সব শ্রেণির মানুষের যোগাযোগ আছে। যার প্রতি মানুষের আস্থা ও জনসমর্থন রয়েছে। জনগণের সমর্থন যার সঙ্গে থাকবে, তাকেই আমরা প্রাধান্য দেব।’ তৃণমূলের মতামতের গুরুত্ব সম্পর্কেও কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার ভাষায়, ‘তৃণমূলের মতামত অবশ্যই আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি। গণতন্ত্রে বিভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক। কোনো এলাকায় ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন একটি মত দেবে, ১৫ জন আরেকটি মত দেবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা যেখানে মেজরিটির মত পাই, সেটিকেই গুরুত্ব দিই।’ ‘আমরা কিন্তু দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না, বরং এমন একজনকে বেছে নিতে চাইছি, যিনি শুধু দলের নয়, দলমত নির্বিশেষে এলাকার অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পান। কারণ নির্বাচনে শুধু দলীয় সমর্থন যথেষ্ট নয় জনগণের অংশগ্রহণই এখানে মুখ্য।’
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ