প্রমত্তা যমুনার বুকে ইতোমধ্যে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। ৫০টি পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যান বসিয়ে এ সেতুর পুরো ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার সুপার স্ট্রাকচার এখন সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। তবে উভয়পাশের স্টেশন নির্মাণ, স্লিপারবিহীন রেলপথ স্থাপনসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। রেলসেতুতে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণও শেষের দিকে। আগামী ডিসেম্বরেই সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের পথে ট্রেনযাত্রায় স্বস্তি আসছে শিগগিরই। জানা যায়, উত্তরবঙ্গের প্রধান তিন রুটের শেষ গন্তব্য পঞ্চগড়, বুড়িমারী, কুড়িগ্রাম রুটে ঢাকা থেকে স্বাভাবিক শিডিউলেই ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। আর ঈদ কিংবা শিডিউল বিপর্যয় হলে বিপাকে পড়তে হয় এ রুটের যাত্রীদের। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণের ফলে এ রুটে গড়ে এক ঘণ্টা সময় বাঁচবে। শিডিউল জটিলতা তৈরি হলে ডাবল লাইন হওয়ায় এ লাইনে ক্রসিংয়ে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না যাত্রীদের। ফলে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলা এবং খুলনা বিভাগের ১০ জেলার যাত্রীদের ভোগান্তি কমবে। যাত্রাপথে আসবে স্বস্তির ছোঁয়া। সেতুতে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে ট্রেন। সেতু পার হতে সাড়ে তিন থেকে চার মিনিটের মতো লাগবে। ফলে এখন যে এক ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়, সেই ভোগান্তি কমবে। রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে ৪৮টি ট্রেন বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু ব্যবহার করে। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু উদ্বোধনের পর ৮৮টি ট্রেন চলবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই হবে পণ্যবাহী ট্রেন। এতে উত্তরবঙ্গ থেকে সহজে পণ্য পরিবহন করা যাবে রাজধানী ঢাকায়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে ব্রডগেজ পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল নিষিদ্ধ। রেলসেতু চালু হলে এ পথে কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে আয়ের নতুন পথও খুলে যাবে। এ রেলপথে আয় বাড়াতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টেশনগুলোতে পণ্য পরিবহনে বিশেষ করে কাঁচামাল পরিবহনের উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করা শিল্পকারখানার কাঁচামাল রেলযোগে সরাসরি উত্তরবঙ্গে নেওয়ার সুব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই এই রেলসেতুর পুরোপুরি সুফল আসবে। এ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানবিরুল ইসলাম জানান, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পণ্য পরিবহনে এ সেতুর মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। সেতুটি চালু হলে উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগে যেমন গতি বাড়বে, তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রেলে পণ্য পরিবহনের সক্ষমতাও তৈরি হবে। রেল সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু রেলসেতুটি চালু হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের রেলযোগাযোগ ও রেলওয়ে পরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ট্রান্সএশিয়ান রেলপথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি বেগবান হবে। যমুনার নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে দেশের দীর্ঘতম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতু নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে ৭২ ভাগ অর্থ ঋণ দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। জাপানের আইএইচআই, এসএমসিসি, ওবায়শি করপোরেশন, জেএফই ও টিওএ করপোরেশন এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ অংশে দুটি প্যাকেজের আওতায় ৫০টি পিলার ও ৪৯টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর স্প্যানে স্লিপারবিহীন রেললাইন বসানো হচ্ছে। দেশের রেললাইনে জাপানি এ প্রযুক্তির ব্যবহার এটাই প্রথম। এ প্রযুক্তিতে স্টিল স্ট্রাকচারের গার্ডারের সঙ্গে রেললাইনের সংযোগ প্রযুক্তিতে কোনো স্লিপার থাকবে না। রেলসেতুতে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ দুই ধরনের রেললাইনের সমন্বয়ে ডুয়েলগেজ ট্র্যাক বসানোর কাজ চলছে। রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে বঙ্গবন্ধু সেতু। যমুনা নদীর ওপর স্থাপিত বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে এসব অঞ্চলের যানবাহন চলাচল করে। এর এক পাশে এক লাইনের একটি রেললাইন রয়েছে। এটি দিয়ে ঘণ্টায় মাত্র ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে। এতে সেতুর দুই পাশে অন্য ট্রেন অপেক্ষা করতে হয়। এ কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ে এই সড়ক সেতুর ৩০০ মিটার উজানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ করছে। এছাড়া সেতুর দুই পাশে দশমিক ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ ও সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশন ভবন আধুনিকের পাশাপাশি ইয়ার্ড রিমডেলিং করা হবে। সেতুর এই দুই পাশের স্টেশনের সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা করা হবে উন্নত। ওই সেতু এলাকায় নির্মিত হবে রেলওয়ে সেতু জাদুঘর। প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, আশা করি, আগস্ট মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের যে রেলসেতুগুলো রয়েছে তাতে আছে একটি করে লাইন। এই সেতুতে দুটি লাইন থাকবে। সেতু পার হওয়ার জন্য কোনো ট্রেনকে অপেক্ষা করতে হবে না। সেতুতে একসঙ্গে দুটো ট্রেন দুদিকে চলে যেতে পারবে। সাধারণত মালবাহী ট্রেনগুলোকে প্রায়ই দুটি ইঞ্জিন দিয়ে টানতে হয়। বঙ্গবন্ধু সড়কসেতুতে যা সম্ভব হয় না। এ কারণেই যমুনা নদীর ওপারে পার্বতীপুরের কারখানায় মেরামতের জন্য ইঞ্জিন নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। রেলসেতুটি নির্মাণ করা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাজ
উত্তরের পথে ট্রেনযাত্রায় আসছে স্বস্তি
- আপলোড সময় : ০৩-০৬-২০২৪ ১০:৫৯:৩৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৬-২০২৪ ০১:২০:১১ পূর্বাহ্ন
উত্তরের পথে ট্রেনযাত্রায় আসছে স্বস্তি
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ