গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, সমুদ্র পেরিয়ে মানবতার বার্তা
- আপলোড সময় : ০৫-১০-২০২৫ ১২:৫৩:৩০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৫-১০-২০২৫ ১২:৫৩:৩০ অপরাহ্ন
গাজায় ইসরায়েলি বোমার গর্জন তখনো থামেনি, থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে অবরুদ্ধ উপত্যকার আকাশ, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ফিলিস্তিনিদের রক্তমাখা ধূলিকণা। ঠিক এমন এক সময়ে উত্তাল সমুদ্রে পাল ওড়ালো একঝাঁক নৌকা। গাজায় অবরোধ ভাঙার লক্ষ্যে শুরু হলো এক দুঃসাহসী যাত্রার। পেছনে ঝড়ের গর্জন, সামনে দখলদারদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। এর মধ্যেই এগিয়ে যায় গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, সমুদ্র পেরিয়ে পৌঁছে দেয় মানবতার বার্তা।
গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা শুধু মানবিক সাহায্যের কোনো বহর নয়, বরং অন্যায় অবরোধের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সংহতি এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি দেখিয়ে দিচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ-এর পেছনে বিশ্বের অবহেলার দায় কতটা।
ফ্লোটিলার কর্মীরা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হলেও এরই মধ্যে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন তারা। তাদের এই চেষ্টা প্রমাণ করে দিয়েছে, মানবতার কণ্ঠস্বর কখনো দাবিয়ে রাখা যায় না।
গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা একটি আন্তর্জাতিক নৌ অভিযান, যার লক্ষ্য ইসরায়েলি অবরোধ ভেঙে গাজাবাসীর কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। আজ অবধি গাজা অভিমুখে সবচেয়ে বড় নৌ অভিযান এটি। গত আগস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে স্পেন, ইতালিসহ একাধিক দেশের বন্দরগুলো থেকে যাত্রা শুরু করে সুমুদ ফ্লোটিলার নৌযানগুলো।
আরবি শব্দ ‘সুমুদ’-এর অর্থ ‘স্থিতিস্থাপকতা’ বা ‘অটলতা’। এটি ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ এবং অধিকারের জন্য অবিচল সংগ্রামকে নির্দেশ করে। আর স্প্যানিশ শব্দ ফ্লোটিলা মানে ছোট নৌবহর। অর্থাৎ, ‘গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামটি বিশ্বের সংহতি এবং নৌ অভিযানের মাধ্যমে অবরোধ ভাঙার লক্ষ্যকে তুলে ধরে।
গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় অন্তত ৪৪টি দেশ থেকে ৫০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত অ্যাকটিভিস্ট, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী এবং সাধারণ নাগরিক। সুইডিশ পরিবেশবাদী আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গ এর অন্যতম প্রধান মুখ। বাংলাদেশ থেকে শহিদুল আলম যোগ দিয়েছেন সুমুদ ফ্লোটিলায়, রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক রুহি আক্তারও। এর বাইরেও ফ্লোটিলায় রয়েছেন ইউরোপীয় এমপি, আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য এবং মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এই বৈচিত্র্যময় দলটি দেখিয়ে দিচ্ছে, মানবতার আহŸান শুধু একটি ধর্ম বা জাতির নয়, বরং বিশ্বের সবার। গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা তার সংক্ষিপ্ত সমুদ্রযাত্রায় গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর জাহাজগুলোতে ১০ হাজার টনেরও বেশি ত্রাণ—ওষুধ, খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং নির্মাণ উপকরণ রয়েছে, যা গাজার দুর্ভিক্ষ-আক্রান্ত জনগণের জন্য অত্যাবশ্যক।
গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশ করে ইসরায়েলের অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বার্তা প্রচার শুরু করে। এর প্রতিটি নৌযান থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ স্ট্রিমিং করা হয়। এটি আগের ফ্লোটিলাগুলোর মতো (যেমন- ২০১০-এর মাভি মার্মারা) শুধু সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং অবরোধকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবেও চ্যালেঞ্জ করেছে।
নৌযানগুলো ‘অটলতার গান’ গেয়ে এগিয়েছে, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে উঠেছে। এছাড়া, ফ্লোটিলা জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানেসের মতো বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে গাজা যুদ্ধের মিডিয়া কভারেজ বেড়েছে এবং বিশ্বনেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ইসরায়েলি নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বেশিরভাগ নৌযান আটক করেছে। এছাড়া, গত ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রিসের কাছে অজ্ঞাত ড্রোন হামলায় ফ্লোটিলার জাহাজগুলোতে স্টান গ্রেনেড এবং চুলকানির পাউডার ফেলে ক্ষতি করা হয়, যদিও কোনো হতাহতের ঘটনা হয়নি। এরপর, ১-২ অক্টোবর ইসরায়েলি কমান্ডোরা ক্যাপ্টেন নিকোস, ম্যারিনেটসহ অন্যান্য জাহাজে উঠে নিয়ন্ত্রণ নেয়। গ্রেটা থুনবার্গসহ শতাধিক কর্মীকে আটক করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইসরায়েল দাবি করেছে, গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলার কর্মীরা সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন এবং ইসরায়েলের বৈধ অবরোধ লঙ্ঘন করেছেন। আটক কর্মীদের ইউরোপে ফেরত পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে তেল আবিব। তবে অ্যাকটিভিস্টরা একে ‘অবৈধ হামলা’ অভিহিত করে বলেছেন, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন লঙ্ঘন করে।
সুমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হানার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। তুরস্ক এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলকে ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’-এর জন্য নিন্দা করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা বলেছে, ফ্লোটিলা ‘গাজার সঙ্গে সংহতির প্রতীক’। কলম্বিয়ান প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন। ইতালিতে ট্রেড ইউনিয়নগুলো সাধারণ হরতাল ডেকেছে। বুয়েনস আয়ার্স, ইস্তাম্বুল, এথেন্স, রোম, বার্লিন ও মাদ্রিদে হাজারও মানুষ রাস্তায় নেমেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, ইসরায়েলের ‘দীর্ঘদিনের অবাধ অপরাধ’ শেষ হতে হবে।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানেস একে ‘পশ্চিমের নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ’ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফ্লোটিলা কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহŸান জানিয়েছে। ইউরোপীয় কমিশন ফ্লোটিলাকে সমর্থন না করলেও আইনি প্রক্রিয়া দাবি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হয়েছে। গেøাবাল সুমুদ ফ্লোটিলার জাহাজগুলো যদিও ইসরায়েলের হাতে আটক হয়েছে, তবু এর বার্তা অমলিন। এটি দেখিয়ে দিয়েছে, অবরোধের মুখে মানবতার জাহাজগুলো থামবে না। এটি গাজাবাসীর জন্য একটি আশার আলো। এটি বিশ্ব বিবেককে মনে করিয়ে দিচ্ছে, স্থিতিস্থাপকতা এবং সংহতি যুদ্ধের চেয়েও শক্তিশালী। ফ্লোটিলার নেতারা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আরও অভিযান আসবে। অর্থাৎ গল্প এখানে শেষ নয়, বরং নতুন গল্পের শুরু হলো মাত্র।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
দৈনিক জনতা ডেস্ক :