ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
সরকারি চাকরি আইন বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভে কর্মচারীরা ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড ৬ জনের যাবজ্জীবন বহাল কালো টাকা সাদা করার বিধান সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীত-টিআইবি দূরত্ব ঘুচিয়ে চমৎকার জুলাই সনদ তৈরির প্রত্যাশা প্রধান উপদেষ্টার সারাদেশে একযোগে ২৫২ বিচারককে বদলি টেকসই অর্থনীতির বাজেট এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বঞ্চনার গল্প যেন অরণ্যেরোদন চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলে ৩ উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিলেন কর্মচারীরা রাষ্ট্র সংস্কারে উপেক্ষিত নারী তারেক রহমানসহ সব আসামির খালাসের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু-আইন উপদেষ্টা শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি প্রথমবারের মতো বিটিভির স্টুডিও থেকে হচ্ছে বাজেট ঘোষণা ঘাটতি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে নতুন বাজেট আজ দুধ শুধু পণ্য নয় এটি সংস্কৃতির অংশÑ মৎস্য উপদেষ্টা রাঙামাটিতে টানা বৃষ্টি পাহাড় ধসের ঝুঁকি সিলেটে টিলা ধসে একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু বিজিএমইএ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে ‘ফোরাম’ প্যানেল বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে লাশ নিয়ে গেছে বিএসএফ জাপা চেয়ারম্যানসহ ২৮০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার মামলা
# মূল টার্গেট অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার # ঘাটতি মেটাতে ঋণ নির্ভরতা চাপ বাড়াবে অর্থনীতিতে # সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে থাকবে দিকনির্দেশনা # দেখা যাবে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন

বাজেট ২০২৪-২৫ : নতুন বাজেটে তিন চ্যালেঞ্জ

  • আপলোড সময় : ০৩-০৬-২০২৪ ০৭:১০:৪৮ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৪-০৬-২০২৪ ০১:২১:১১ পূর্বাহ্ন
বাজেট ২০২৪-২৫ : নতুন বাজেটে তিন চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিতে টানাপড়েন, আইএমএফ’র নানা শর্ত পূরণ আর অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আগামী ৬ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা আসছে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। যা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট। এসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখা যাবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। এটি হবে বর্তমানে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট উত্থাপন। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ফলে ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ১.৫৭ গুণ বেশি। জানা গেছে, বৈশ্বিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। একদিকে স্বস্তি দিতে গিয়ে অন্যদিকে টান পড়ছে। কৃচ্ছ্রসাধনের পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখতে হচ্ছে আইএমএফ’র শর্তের বিষয়েও; যেন কোনো অবস্থাতেই ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি কিস্তিগুলো আটকে না যায়। অন্যদিকে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছেই। প্রায় এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ৬ জুন জাতির সামনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার শীর্ষক এ বাজেটের মূল লক্ষ্য থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। স্বাভাবিকভাবেই এবার সংকোচনমূলক বাজেট দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রস্তুত করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে পারে। মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে বেরোনোর জন্য বাড়ানো হতে পারে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কী হতে পারে, এবারের বাজেট উত্থাপনের সময় একটি বিশ্লেষণ থাকতে পারে। রাজস্ব আয় বাড়াতে অধিকসংখ্যক মানুষকে করজালের আওতায় নিয়ে আসার ছকও আঁটা হচ্ছে। এজন্য কিছু নতুন ক্ষেত্রে করারোপ হতে পারে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, চারটি মূল স্তম্ভের ওপর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি। এই স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ।
স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরুর অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মুস্তফা কামাল মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। তবে সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশে সমন্বয় করা হয়। আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্র মূল বাজেটে ৫ লাখ কোটি টাকা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তবে অর্থবছর শেষে এই দুটির একটিরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
এ পরিস্থিতিতে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দেবেন, সেখানে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ ধরা হতে পারে। আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হতে পারে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া কর ব্যতীত আয় বা এনটিআর’র লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৫৫ হাজার কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। এজন্য এবার জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারামূল্য বাড়ানো হতে পারে। একই সঙ্গে জমির নামজারির ফি, মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা আরোপ করে, সেক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্তের প্রতিফলন দেখা যেতে পারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির অন্যতম শর্ত হলো, আগামী অর্থবছর কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণ, কর প্রশাসনের সংস্কার ও আদায় প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফ’র শর্তের কারণেই এবার বাজেটে কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এজন্য গম, ভুট্টা, সরিষাবীজ, তুলাবীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, পেনিসিলিন, ইনসুলিন, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক কয়েল, পেপার বোর্ড, স্টিলজাতীয় পণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ অর্ধশতাধিক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। বর্তমানে এসব পণ্যের শূন্য শুল্ক রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিশেষ সুবিধায় কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করা হতে পারে। কালো টাকা অর্থনীতির মূলধারায় আনতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানেও এ সুযোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত আয় থেকে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিলে ওই বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস সম্পর্কে আয়কর বিভাগ থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অবশ্য মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও দেয়া হতে পারে এবার।
এছাড়া আগামী বাজেটে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশ এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। কোমলপানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, ফলের জুস, আমসত্ত্বার ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এছাড়া কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর ২ শতাংশ বাড়িয়ে করা হতে পারে ৫ শতাংশ।
ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আসতে পারে। ফলে বাড়তে পারে ব্যাংকে জমা টাকা রাখার খরচ। বর্তমানে এক বছরের মধ্যে যে কোনো সময় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত স্থিতি হলে ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়, আগামী বাজেটে এটা বাড়িয়ে ২০০ টাকা হতে পারে। আর ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর ৩ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। আগামী অর্থবছর ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা এবং ৫০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকার ওপর ৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এছাড়া ১ কোটি থেকে ২ কোটি টাকার হিসাবধারীদের ওপর ১৫ হাজার এবং ২ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত হিসাবধারীদের ওপর ২০ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। বর্তমানে ১ থেকে ৫ কোটি পর্যন্ত ব্যাংকে স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকা। আর ৫ কোটি টাকার ওপরে জমা থাকা অর্থের ওপর আবগারি শুল্ক ৫০ হাজার টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য এটি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
এদিকে দেশীয় শিল্পের বিকাশে ২০২৩-২৪ বাজেটে ল্যাপটপ-কম্পিউটার আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। ফলে ল্যাপটপ আমদানিতে করহার দাঁড়ায় ৩১ শতাংশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ পণ্যটিতে শুল্ককর কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হতে পারে। বিয়ে করতে গেলে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নেয় বর-কনে দুপক্ষই। নতুন বাজেটে কমিউনিটি সেন্টারের সেবা নিতে গেলে রিটার্ন জমার সনদ দিতে হবে, এমন বিধান আসতে পারে। এছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট আদায় বাড়াতে সিকিউরিটিজ সার্ভিস সেবার বিপরীতে ভ্যাটের হার ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। এতে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি সার্ভিসেও আগামী অর্থবছরে বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে। এছাড়া রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনসহ ইলেকট্রনিকস পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটের হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। রেফারেল হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত ২০০টিরও বেশি মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক বাড়তে পারে। ফলে বাড়তে পারে চিকিৎসা ব্যয়। এ ধরনের হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এসব চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি অবশ্য বর্তমানে অন্যান্য শুল্ক ও ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত। দেশের প্রধান রেফারেল হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে বারডেম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, জয়নুল হক সিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইব্রাহিম ইকবাল মেমোরিয়াল হাসপাতাল লিমিটেড প্রভৃতি।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় বরাদ্দ রাখা হতে পারে ১ লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু বিদ্যুৎখাতের জন্যই বরাদ্দ থাকবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঋণাত্মক ৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হতে পারে।
নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হতে পারে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হতে পারে। সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হতে পারে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। এ খাতের বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭০ হাজার ৬৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, শিক্ষাখাত ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি ২৪ হাজার ৮৬৮ কোটি ৩ লাখ টাকা, স্বাস্থ্যখাতে ২০ হাজার ৬৮২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং কৃষিখাতে ১৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হতে পারে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলতে থাকায় তা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ নেয়ায় তারল্য সংকট পরিস্থিতিও দেখা দিয়েছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বারবার চাপের মুখে পড়ার কথা বলে আসছেন তারা। তবুও আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতির এমন চক্র মেনে নিয়েই বাজেট দিতে হচ্ছে সরকারকে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। ঘাটতির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকেই রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার আনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী, সংকোচনমূলক বা বাজেট ছোট রাখাও এবার অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারও বাজেট বাস্তবায়নে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এছাড়া সরকার আগামী বাজেটে ঘাটতি রোধ, রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও কৃষকদের জন্য সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য ঠিক করতে চাইছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, গত দুই-তিন বছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু গত দুই বছরে যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনেন, তাদের আয় ২০ থেকে ২৪ শতাংশ কমেছে। ফলে বর্তমান বাজেটেই আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে কেউ বিদেশ যেতে; আবার কেউ স্কুলে বাচ্চা ভর্তি বা নাস্তায় ডিম খেতে পারছি না। যা আয় করছি, তাতে ব্যয় কুলাতে পারছি না। আবার দাম বাড়ার কারণগুলোই এত জটিল- তা দ্রুত সমাধান করা অসম্ভব। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলোর একটি থেকে আরেকটি আলাদা নয়। আমরা একদিকে বলছি- মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ, আবার বলছি বৈদেশিক মুদ্রার চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জও দেখছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গেলে আরেকটি চ্যালেঞ্জ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই যে একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক- এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে ঠিক করতে হবে-কোন সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে।
অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়িয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ দিতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। সরকার প্রশাসনে কিছু সংস্কার করুক, যেটার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব। এতগুলো মন্ত্রণালয় রাখার কোনো দরকার নেই। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মত দফতর রেখে রেখে বড় ধরনের ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো আস্তে আস্তে উঠিয়ে দেয়া দরকার। একটি মন্ত্রণালয়ের সাথে যে বিশাল বাহিনী, গাড়ির বহর- এগুলোর দরকার নেই। অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, চ্যালেঞ্জে থাকা অর্থনীতির চাপ কমাতে খরচের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে, যা সরকার করতে পারছে না। টাকা খরচ করাটাই মূল নয়। সঠিকভাবে বরাদ্দ হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। আমাদের যেহেতু আয় কম, তাই খুব বেশি ব্যয় করার উপায় নেই। কোন খাত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেখানে খরচ আগে করতে হবে। অপচয় না করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ সুফল পাবে, সেই জায়গাটিতে ব্যয় করতে হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, বাজেটে ঘাটতি বেশি হলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায়। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ঠিক রাখতে হলে অবধারিতভাবে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশকে কেউই সহজ ঋণ দিতে চাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ কম। প্রতিবছর এই ঘাটতি হওয়া মানেই হচ্ছে অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাওয়া। সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের সিংহভাগ খেয়ে ফেলবে। সুতরাং বাজেটে ভারসাম্য হওয়ার খুব দরকার ছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাজেট ছোট রাখা। আমাদের ডিমান্ড কন্ট্রোল করা দরকার। অর্থাৎ সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনা দরকার। এডিপির সাইজ বড় করা যাবে না। কারণ আমাদের বৈদেশিক ঋণে যে পরিমাণ চাপ পড়ছে এবং তা পরিশোধের ঝুঁকি বাড়ছে। যেহেতু অভ্যন্তরীণ আয় অর্থাৎ রাজস্ব আহরণের মাধ্যমেই প্রকল্পগুলো আগামীতে বাস্তবায়ন বেশি দেয়া দরকার। কারণ আমাদের ঋণ পাওয়া ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ হবে; না পাওয়ার ঝুঁকিও আছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এমন এক সময় আগামী বাজেট আসছে, যখন দেশের অর্থনীতি বহু সংকটে নিমজ্জিত রয়েছে। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এছাড়া চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি, রিজার্ভের চাপ, রফতানি আয়-রেমিট্যান্সেও নেই সুখবর। ডলারের বাজারে খারাপ অবস্থা। ব্যাংক ও আর্থিক খাতেও চলছে দুর্দশা। এছাড়া দাতা সংস্থার ঋণ ও সহায়তা প্রাপ্তিও সন্তোষজনক নয়। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেও চলছে খরা, নতুন কর্মসংস্থানেও চলছে হতাশা। আমি মনে করি, এত সমস্যার মধ্যে বাজেটে সবার আগে গুরুত্ব দেয়া উচিত উচ্চ মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে দিকটিতে। কারণ বিগত দুই-তিন বছরে দেশে প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম এতটাই অস্বাভাবিক বেড়েছে- দেশের সাধারণ মানুষের এখন তিন বেলার আহার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ অর্থ উপদেষ্টা একই কারণে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার দিকেও অধিক গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন। ব্যাংক খাত এখন খাদের কিনারে। বলা যায়, ব্যাংক খাত এক রকম ঠেকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত। এ জন্য আগামী বাজেটে ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে। আমি দেখার অপেক্ষায় থাকব নতুন বাজেটে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয়। এই সমস্যা নিরসনে প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। তিনি বলেন, কৃষিজাত পণ্য ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সার, বীজ ইত্যাদিতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিদ্যুতেও দেওয়া হয়। খাদ্যসহায়তার জন্য শেখ হাসিনার সরকার গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে বেরোনোর জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য অভিঘাত কী হতে পারে, তা আগের বাজেটগুলোতে ছিল না। এবার বাজেট উত্থাপনের সময় সেই সংক্রান্ত একটি বিশ্লেষণ দেয়া হবে। প্রতি বছর যেভাবে জেন্ডার বাজেটের একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়, ৪৪টি মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদন তৈরি করে। এবার প্রথমবার আইবাস (সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি) থেকে দেখতে পাবে বরাদ্দগুলো সংশ্লিষ্ট খাতে যাচ্ছে কি না।


 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স