* রাজধানীর শতকরা ২০-২৫ শতাংশ বাণিজ্যিক স্পেস খালি পড়ে আছে
* অলস পড়ে আছে বহু বাণিজ্যিক স্পেস, খেলাপি ঋণ বাড়ার শঙ্কা
* তরুণরা ব্যবসায় আসছেন না, বরং অনেকে দেশ ছাড়ছেন
* রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম
* গত এক বছরে অনেক ব্যবসায়ী কমার্শিয়াল ফ্লোর ছেড়ে দিয়েছেন
* সংকট কাটাতে এই খাতে বিশেষ তহবিল গঠনের দাবি সংশ্লিষ্টদের
রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, আর্থিক সংকট এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের ফলে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় নতুন বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যিক স্পেস বা কমার্শিয়াল ফ্লোর ভাড়ার বাজারে। কাক্সিক্ষত ভাড়াটিয়া না মেলায় ফাঁকা পড়ে আছে অনেক বাণিজ্যিক স্থাপনা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা এসব ভবন ভাড়া বা বিক্রি না হওয়ায় একপর্যায়ে তা খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে।
রিয়েল এস্টেটখাত সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাণিজ্যিক স্পেস খালি পড়ে রয়েছে। এতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন ভবন মালিকরা। সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। খেলাপি ঋণ আরও বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, নির্মাণ খাতে ২০২৪ সালে এক লাখ সাত হাজার ৭৫২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৬৮ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক।
অন্যদিকে, গৃহঋণ বা হাউজিং ফাইন্যান্স খাতে ২০২৪ সালে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ চার হাজার ৭৫ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ)। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ০৯ শতাংশ।
ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগে স্থবিরতা ও এর প্রভাব নিয়ে কথা হয় এমবিট হোমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. হারুন অর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ব্যবসা কার্যত স্থবির। অনেক উদ্যোক্তা কমার্শিয়াল স্পেস তৈরি করেও বিক্রি বা ভাড়া দিতে পারছেন না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কেউ নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তরুণরা ব্যবসায় আসছেন না, বরং অনেকে দেশ ছাড়ছেন।
হারুন অর রশিদ আরও বলেন, কমার্শিয়াল স্পেসের ভাড়া আবাসিকের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি। কিন্তু বাজারে চাহিদা নেই, ফলে বিনিয়োগকারীরা রিটার্ন নিয়ে সন্দিহান। এর সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা চারদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের বিশেষ সহায়তা ছাড়া এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরোনো বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে একের পর এক ফ্লোর খালি হয়ে যাচ্ছে। পুরোনো ভাড়াটিয়ারা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন, কিন্তু নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে নতুন নির্মিত ভবনের অনেকগুলোতে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় ভাড়া দিতে পারছেন না মালিকরা। কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি, কোথাও লিফট চালু হয়নি, আবার কোথাও নেই পর্যাপ্ত পার্কিং। ফলে চকচকে ভবনও পড়ে আছে অলস। রিহ্যাব সূত্রে জানা যায়, নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও আর্থিক সংকটে মালিকরা ইন্টেরিয়র ও অন্যান্য অবকাঠামোগত কাজ শেষ করতে পারছেন না। ফলে সেগুলোও খালি থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ায় বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
পুরান ঢাকার চিপস ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদ বলেন, কমার্শিয়াল স্পেস নিতে গেলে ছয় মাস থেকে এক বছরের অগ্রিম ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু দেশে কোন সরকার আসবে, কী হবে, এসব অনিশ্চয়তায় অনেকেই এখন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। আমার ক্ষেত্রেও তাই, আরও কিছুটা দেখি, এর মধ্যে নিজেকেও গুছিয়ে নেই। গত এক বছরে অনেক পুরোনো ব্যবসায়ী কমার্শিয়াল ফ্লোর ছেড়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অনেকে দেশ ছেড়ে গেছেন। এতে খালি হয়েছে অনেক বাণিজ্যিক স্পেস। কিন্তু সেই অনুপাতে নতুন ব্যবসায়ী আসছেন না। ফলে ভাড়াটিয়া না মেলায় অলস পড়ে আছে বহু বাণিজ্যক স্পেস।
আলভি এন্টারপ্রাইজের মালিক জাহিদ উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। একাধারে তিনি আমদানিকারক এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, এর আগে আমার দুটি অফিস ছিল, এখন কমিয়ে একটিতে এনেছি। তবে যেটা ছেড়ে দিয়েছি, সেটি নতুন করে ভাড়া বা বিক্রি কোনোটাই হয়নি এখন পর্যন্ত। দামও কম বলছেন ক্রেতারা। মূলত খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছি। পরিস্থিতি ভালো হলে আবার বাড়ানোর চিন্তা করব।
বৈশ্বিক অস্থিরতাও দেশের বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংঘাত, ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ না পাওয়া-সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। জমি বা স্পেস থাকলেও টাকা নেই, তাই ফাঁকাই থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারেও অস্থিরতা চলছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের রফতানি ও উৎপাদনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত বছরের উৎপাদন কার্যক্রমে দীর্ঘ সময়ের বিঘ্ন, যা আরও লোকসান ডেকে এনেছে।
ফজলে শামীম এহসান আরও বলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। তাছাড়া ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক সংকটও ব্যবসা প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ব্যবসায়িক পরিবেশ স্থবির হয়ে পড়েছে, কারণ ব্যবসার পরিধি বাড়ছে না। সব মিলিয়ে নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া বড় অঙ্কের অর্থ লগ্নি সম্ভব নয়।
রিহ্যাবের তথ্যমতে, তাদের সদস্যদের প্রায় এক হাজার ৮০০টি প্রকল্প বর্তমানে চলমান। এসব প্রকল্পে রয়েছে আনুমানিক ১৮ হাজার ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট। তবে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুমোদন ও পরিকল্পনা জটিলতা না থাকলে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বাড়ত। তবে প্রকল্পে যে সংখ্যক ফ্ল্যাট বা স্পেস রয়েছে সেই অনুপাতে ভাড়া বা বিক্রি হচ্ছে না।
এ বিষয়ে কথা হলে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে অনেক এলাকায় কমার্শিয়াল স্পেস ফাঁকা পড়ে আছে। কোথাও কোথাও অবিক্রীত কিংবা ভাড়া হয়নি এমনও আছে। ভাড়াটিয়া না পাওয়ায় কিংবা বিক্রি না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ সংকটের সময়ে যদি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে, তাহলে উদ্যোক্তারা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে। এতে ব্যাংক খাতকেও খেলাপি ঋণমুক্ত রাখা সম্ভব হবে। সংকট কাটাতে এ খাতে বিশেষ তহবিল গঠনের দাবি জানান রিহ্যাবের লিয়াকত আলী ভূঁইয়া।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
