* ৫ আগস্টের পর থেকে আরও বেপরোয়া কিশোর গ্যাং গ্রুপ
* উত্তরায় কিশোর গ্যাং থেকে রেহাই পাচ্ছে না পথচারীরাও
* জেল থেকে ছাড়া পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী-মাদক কারবারিদের ছত্রছায়ায় তাণ্ডব
* ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর
* সারাদেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে
* রাজধানীতেই রয়েছে ১২৭টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয়
কামরুজ্জামান
রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ে বাড়ছে বিভিন্ন অপরাধ। কিশোর-তরুণ গ্যাং এর সদস্যরা হত্যা, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এসব অপরাধীরা সুযোগ পেলেই নারীদেরও উত্ত্যক্ত করছে। ৫ আগস্টের পর কেউ দল বদেলেছে, কেউ বদলেছে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। কেউ আবার পুরোনোকে সরিয়ে আবির্ভূত হয়েছে নতুন রূপে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য বলছে, সম্প্রতি এই গ্যাংয়ের সদস্য আরও বেড়েছে। সারাদেশেই তাণ্ডব চালাচ্ছে তারা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেকোনো স্পটে এ ধরনের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটলেই তাদের নামটা শুরুতেই উচ্চারিত হচ্ছে কিশোর গ্যাং।
জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরায় চুরি ও ছিনতাই যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এক অজানা আতঙ্ক নিয়ে প্রতিদিন জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গত শনিবার বিকেলে উত্তরা উত্তর ও উত্তরা সেন্টার মেট্রোস্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে প্রাইমারী ও হাইস্কুল লেভেলের পাঁচজন ছাত্র ঘুরতে আসলে পূর্বে থেকে ওৎপেতে থাকা কিশোর অপরাধীর তিন সদস্য তাদের উপর আক্রমণ করে। একপর্যায়ে কোমলমতি ছাত্রদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মেট্রোস্টেশনের সামান্য দূরে ঝোপের কিনারায় নিয়ে তাদের মোবাইল ফোন ও সাথে থাকা টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। দৈনিক জনতার উত্তরা প্রতিনিধি দূর থেকে বিষয়টি লক্ষ্য করে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে ছাত্রদের ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায় কিশোর গ্যায়েংর সদস্যরা।
ভুক্তভোগীরা দৈনিক জনতাকে জানায়, অপরাধীদের মধ্যে একজন নিজেকে তালাচাবি রাজু বলে পরিচয় দিয়েছে। পরে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অন্যান্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উত্তরার দিয়াবাড়ি ও আশপাশের মেট্রোরেল লাইনের জনশূন্য জায়গাগুলোতে প্রায়ই ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা। রাত্র আটটা বাজালেই বাড়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম। এলাকাবাসী জানান, একটা মোবাইল ফোন, কিছু টাকা অথবা সামান্য স্বর্ণালঙ্কারের জন্য যে কারোর?ই প্রাণহানি ঘটতে পারে যেকোনো সময়। তাদের দাবি-এসব সন্ত্রাসীরা সর্বক্ষণ মেট্রোস্টেশন কিংবা তার আশপাশেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কোন মানুষকে ফাঁকা রাস্তার দিকে আসতে দেখলেই তার পিছু নিয়ে সব লুটে নেয় তার।
একইভাবে সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় চোখ রাখা যাক। ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হন পুলিশের চারজন সদস্য। হামলার ঘটনার নেপথ্যে রায়েরবাজার বোর্ড ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ জড়িত বলে জানায় পুলিশ। নেতৃত্ব দেয় ল্যাংড়া হাসান, ফরহাদ ও চিকু শাকিল। সবমিলিয়ে হামলা চালায় ৩০-৪০ জন। এরপর রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের মধ্যে এক কলা ব্যবসায়ী ও কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এটা ছিল তাদের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। শাখাওয়াত হোসেন ও তার বন্ধু মো. আলমগীর হোসেন উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে থেকে হাউজ বিল্ডিংয়ে যাওয়ার জন্য অটোরিকশা নেন। যাওয়ার পথে কিশোর গ্যাংয়ের ৭-৮ জনের সহায়তায় দুই বন্ধুকে ভয় দেখিয়ে দুটি মোবাইল ও নগদ ১৯ হাজার ৬০০ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরে তাদের আটকে রেখে পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। এভাবে পুলিশও বাদ যাচ্ছে না ভয়ংকর এ গ্যাংয়ের হাত থেকে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সমাজের এহেন বাজে কাজ নেই যাতে তারা করছে না।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অন্তত ১২৭টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। সারা বাংলাদেশে ২৩৭টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্য রয়েছে দুই হাজারের বেশি। প্রতিটি থানায় তাদের তালিকা রয়েছে। পুলিশের দাবির মতে, গত ৫ আগস্টের আগে ও পরে দেশের বেশির ভাগ থানা নাশকতায় ধ্বংস হওয়ায় সেই তালিকাও ধ্বংস হয়ে গেছে। সংগত কারণে এখন নতুন করে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা লাগছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি প্রাণ ঝরে। এর মধ্যে একাধিক আলোচিত হত্যাকাণ্ডও ছিল। গত ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের ঘরোয়া দ্বন্দ্বে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। মূলত আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় পুলিশ ও র্যাব।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি কিশোর অপরাধের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে কিশোর কারাগার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোকে আরো সময়োপযোগী করে সংশোধন কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম করে গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে এই কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতর সূত্র বলছে, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ১২৭টি। সরকার পরিবর্তনের আগে ঢাকায় এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৮২। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। এখন ঢাকার প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে এক হাজার সদস্য রয়েছে। চট্টগ্রামে ৫৭টি গ্রুপে সদস্য ৩১৬।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের আগ্রাসন বেশি। এ আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে কিশোররা। এ কারণে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে দ্বিধাবোধ করছে না। সম্প্রতি অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তাদের ছত্রছায়ায় থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাণ্ডব চালাচ্ছে। কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও আইনের আওতায় আনতে কাজ চলমান।
উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান। মিরপুর এলাকায়-সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারি রাসেল, বিচ্ছু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং। ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, পানিটোলা, লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপ, চিতা গ্রুপের সদস্য অপরাধের শীর্ষে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় বেড়েছে গণছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। কিশোর গ্যাং গ্রুপের মহড়া চলে আদাবরের রাস্তায় রাস্তায়। আধিপত্য বিস্তার বা পূর্বশত্রুতার জেরে জোড়া খুনের ঘটনাও ঘটে মোহাম্মদপুর-রায়েরবাগ এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িত একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ। চলতি বছরের শুরুতে গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আদাবরের মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এতে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর ওপর হামলা করে গ্যাং গ্রুপের কয়েকশ সদস্য। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা আহত হন।
মোহাম্মদপুর স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকায় কিছুদিন পরপর কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা গণছিনতাই চালায়, আবার দেশি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে ভয় লাগে তাদের। মহড়া দেওয়ার সময় বাসাবাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙচুর, লাইট ভাঙচুর করে গ্যাংয়ের সদস্যরা।
পুলিশ জানায়, মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারিদের নেতৃত্বে চলছে কিশোর গ্যাংগুলো। একসময় স্থানীয় ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসু ও কাসুর কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান ছিলেন ডিবি সুমন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাসু ও কাসু পালিয়ে যাওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতে তার ভাই স্বাধীনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে সে। স্বাধীনের ইন্ধনে পুরো এলাকায় ত্রাস কায়েম করতে এমন মহড়া দিয়েছে চক্রটি।
অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান বলেন, কিশোর-তরুণ অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমাজে অপরাধ বাড়বে। আগেও কিশোর অপরাধীরা বেপরোয়া ছিল, সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছিল। এখন আবার তাদের তৎপরতা চোখে লাগছে। বাড়াচ্ছে উদ্বেগও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বিভিন্ন শ্রেণিকরণের মধ্য দিয়ে যেসব তরুণ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। কারণ সমাজের উচ্চবিত্ত বা আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবারগুলো তরুণদের অপরাধ আর সমাজের সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের কিশোরদের অপরাধের ধরন এক নয়। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে ব্যত্যয়গুলো রয়েছে সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনের বিষয়গুলোতে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। পাশাপাশি যারা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকদের তাদের এগিয়ে আসা দরকার।
 
                           
                           
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
                            
                       
     
                            
                         
  
                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                