কুমিল্লা থেকে মো. রজ্জব আলী
ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মহাসড়কে কুমিল্লা অংশেই রয়েছে ১০৪ কিলোমিটার। এই ১০৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে রয়েছে ৪৯টি ইউটার্ন। যা এখন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এসব ফাঁদে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় যুক্ত হচ্ছে লাশের সংখ্যা, থামছে না মৃত্যুর মিছিল। নিত্যদিনের দুঃসংবাদে যুক্ত হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের বিভীষিকাময় খবর। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হচ্ছে সড়কে প্রাণ হারানো পরিবারগুলোর। কে নিবে এই মৃত্যুর দায়?
গত ২২ আগস্ট কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ইউটার্নে একটি লরি উল্টে একটি প্রাইভেট কারকে চাপা দিলে একই পরিবারের ৪ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন: উমর আলী (৮০), তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৬৫) এবং তাদের ছেলে আবুল হাশেম (৫০) ও আবুল কাশেম (৪৫)। দুর্ঘটনায় একটি অটোরিকশার চালক ও যাত্রীসহ আরও ৩ জন আহত হন। দুর্ঘটনায় মা-বাবা ও তাদের দুই ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সড়ক ও জনপদ কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজারের রামপুরের এই মৃত্যুফাঁদ ‘ইউটার্ন’বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন ২৩ আগস্ট বিকেল থেকে অনতিদূরে দয়াপুরের আরেকটি ইউটার্ন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সচেতন মহল বলছেন, ইউটার্নে দুর্ঘটনা বন্ধে এই সিদ্ধান্ত কী যথেষ্ট? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ১০৪ কিলোমিটার এলাকার ৪৯টি ইউটার্ন এখন ভয়ংকর হয়ে ওঠেছে। এসব ইউটার্নের কোনটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এসব স্থানে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা যখন-তখন ইউটার্ন নিচ্ছে। এই ইউটার্ন ঘিরেই গাড়ির চালকদের অসাবধানতা, হঠাৎ করে উল্টা পথে চলাচলে প্রায় সময়ই ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কেউ প্রাণ হারাচ্ছে, কেউ হারাচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
গত ৮ মাসে জেলায় ২০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৪১ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ। হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় জানুয়ারি মাসে নিহত হয়েছেন ১৬ জন, ফেব্রুয়ারি ১৬ মাসে জন, মার্চ ১০ মাসে জন, এপ্রিল মাসে ২২ জন, মে মাসে ২০ জন, জুন মাসে ২৫ জন, জুলাই মাসে ১৮ জন, আগস্ট মাসে ১৪ জন নিহত হয়েছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র কুমিল্লা পদুয়ারবাজার ইউটার্নে গত ৮ মাসে ১৭টি দুর্ঘটনায় অন্তত ২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪০টি। দুর্ঘটনার কারন খুঁজতে গিয়ে হাইওয়ে পুলিশের বিশ্লেষণে উঠেছে এসেছে অতিরিক্ত গতি, উল্টোপথে চলাচল, অসচেতন পথচারী পারাপার, বেআইনিভাবে ইউটার্ন এবং ভাঙাচূড়া সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচলের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যাত্রীবাহী ও ভারী যানবাহনের সংঘর্ষের পৃথক ঘটনায় একই সময়ে একাধিক প্রাণহানি হলেও এককভাবে দ্রুতগতির মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১০৪ কিলোমিটার, কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে ৬৬ কিলোমিটার ও কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের ৪৮ কিলোমিটার সহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে জেলার বিভিন্ন প্রধান প্রধান সংযোগ সড়কে। যদিও মহাসড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যুর খবর আলোড়ন সৃষ্টি করে কয়েক দিন পরপর।
হাইওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘মহাসড়কের সংজ্ঞায় আমাদের মহাসড়ক নেই। মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতার পাশাপাশি সড়কগুলোকেও পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করতে হবে। দিন দিন যে পরিমাণ যান চলাচল ও পথচারী পারাপার বাড়ছে, তা মাথায় রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। আমরা হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে গতি নিয়ন্ত্রণ, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ ও থ্রি হুইলার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকি। আমাদের যে জনবল আছে সে জনবল দিয়ে যতটুকু সম্ভব সবটুকু করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
খাইরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘মহাসড়কে সংজ্ঞায় মহাসড়ক যেমন থাকার কথা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এরকম নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি চলছে কিন্তু অন্য যে গাড়িগুলো ছোট, লোকাল পরিবহন, থ্রি হুইলার গাড়িগুলো চলবে, যেগুলো এলাকার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী চলে, এগুলো চলার জায়গা নেই। মহাসড়কের এপাড়ের মানুষ নিত্য কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য শহরে আসে, আবার শহরের লোকজন আবার বাইরে যাচ্ছে, কিন্ত যাওয়ার জন্য আন্ডারপাস ওভারপাস অথবা মহাসড়কের দুপাশে যে বিশেষ সার্ভিস লেন থাকার কথা সে সার্ভিস লেন নেই। তারপর হোটেলে যাওয়ার জন্য যে ইউটার্নগুলো বানানো হয়েছে সেগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ইউটার্ন রাখলে যারা সেখানে হোটেল ব্যবসা করে তাদের হয়তো ব্যবসায় সফলতা আসছে, কিন্তু লোক মারা যাচ্ছে, এটা আমাদের দেখতে হবে। যে ডিপার্টমেন্ট এই ইউটার্ন বন্ধের দায়িত্বে আছে, বিশেষ করে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে এটা নিশ্চয়ই বন্ধ করবে। এগুলো বন্ধ করলে অন্তত এই জায়গা থেকে আর দুর্ঘটনা ঘটবে না বলে আমি মনে করি।’ সড়ক দুর্ঘটনারোধে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা ‘নিরাপদ চালক চাই’ এর অন্যতম সংগঠক ও মানবাধিকারকর্মী আবদুল হান্নান বলেন, ‘প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা হচ্ছে। মহসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যথাযত পদক্ষেপ ও সঠিক আইন না মেনে গাড়ি চালানো এবং আইনের প্রযোগের প্রচণ্ড অভাবের কারণে এসব দুর্ঘটনা হয় বলে আমি মনে করি। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে মিডিয়ায় আসে, তখন ঊর্ধ্বতন কৃর্তৃপক্ষ নড়েচরে বস। সাময়িক তদারকি করে, এর কিছুদিন পর আবার সব নীরব হয়ে যায়। এটা আমাদের দূর্ভাগ্য যত্রতত্র অধৈর্য নিয়ে গাড়ি চলানোর প্রতিযোগিতা, অদক্ষ চালক ও অসচেতনতার কারণে দুঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে কুমিল্লা জেলায় বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিদিনে আহত ও নিহত হচ্ছে মানুষ। এর প্রতিকার চাই। পরিকল্পিত মহাসড়ক এবং সচেতন যাত্রী ও চালক হলে দুর্ঘটনা সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্টদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
