রাজশাহী প্রতিনিধি
রাজশাহীর মতিহার থানার বামনশিকড় গ্রাম থেকে এক পরিবারের চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ, স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রাথমিক ধারণা, ঋণের বোঝা আর কিস্তির চাপের কারণেই স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে হত্যার পর গৃহকর্তা মিনারুল ইসলাম আত্মহত্যা করেছেন। লাশের পাশ থেকে একটি চিরকূট উদ্ধার করেছে পুলিশ। চিরকূটের এক জায়গায় লেখা আছে, “আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। কিছুদিন আগে পরিবারের পক্ষ থেকে জমি বিক্রি করেও মনিরুলের কিছু ঋণ শোধ করে দেওয়া হয়। তিনি আবারও ঋণগ্রস্ত হয়ে যান।
গতকাল শুক্রবার সকালে খবর পেয়ে মতিহার থানা পুলিশ গিয়ে চারটি মরদেহ উদ্ধার করে। এর মধ্যে মিনারুলের মরদেহ একটি ঘরের মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার নীচে একটি চেয়ার ছিল।
আর মনিরুলের স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ১৪ বছর বয়সী ছেলে মাহিম এবং তিন বছর বয়সী মেয়ে মিথিলার মরদেহ বিছানায় পড়ে ছিল। তাদের শরীরে শ্বাসরোধে হত্যার চিহ্ন প্রাথমিকভাবে পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বামনশিকড় গ্রামের রুস্তম আলী ও আনজুরা বেগম দম্পতির সন্তান মনিরুল। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। কৃষিকাজ, ঠিকা শ্রমিক, বাসের চালকের সহকারী এমন নানা কাজ করতেন। এক বাড়িতেই পরিবারের সবাই বসবাস করেন। মনিরুল বাড়ির দুটি মাটির ঘর নিয়ে থাকতেন। মনিরুলের ছেলে মাহিম খড়খড়ি উচ্চ বিদয়ালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত।
পুলিশ জানিয়েছে, বাড়ির উত্তর পাশের ঘর থেকে মা ও মেয়ের এবং দক্ষিণের ঘরে ছেলে ও বাবার মরদেহ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সেখান থেকে একটি চিরকূটও উদ্ধার করা হয়েছে। স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে যে, চিঠির হাতের লেখা মনিরুলের।
একই বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও মনিরুলের বড় ভাই রুহুল আমিন, তার স্ত্রী দিলরুবা বেগম এবং তাদের মেয়ে হিমু বসবাস করতেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিদিনের মত অন্য সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ১০টার দিকে মনিরুল বাড়ি ফেরেন বলে স্বজনরা পুলিশকে জানিয়েছেন। সকালে পরিবারের লোকজন মনিরুলের ঘরে উঁকি দিয়ে তাদের মরদেহ দেখতে পায়। পরে তারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ সকাল ৯টায় গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।
বামনশিকড় এলাকাটি পবা উপজেলার মধ্যে হলেও তা রাজশাহী মহানগর পুলিশের মতিহার থানার অধীন। ঘটনার পর পরই মহানগর পুলিশের কমিশনার আবু সুফিয়ান, মতিহার থানার ওসি আব্দুল মালেক, পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীদ আলী মোরসেদসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা সেখানে যান। পরে পিবিআই ও সিআইডি ক্রাইমসিনের কর্মকর্তারাও আসেন। এ সময় তারা পরিবারের লোকজনদের পাশাপাশি প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথা বলেন।
সকালে সেই বাড়িতে গিয়ে স্বজন, প্রতিবেশী আর উৎসুক ভিড় দেখা যায়। স্বজনরা কান্নাকাটি করছিলেন। প্রতিবেশীরা পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। স্বজনদের কান্নাকাটির মধ্যেও মনিরুলের ঋণের বিষয়টি নিয়ে তারা বিলাপ করছিলেন।
পুলিশ মনিরুলের লাশের পাশ থেকে একটি চিরকূট উদ্ধার করেছে। চিরকূটটি বড়। সেই চিরকূটে হত্যা ও আত্মহত্যার কারণে হিসেবে ঋণের বোঝার কথা বলেছেন। চিরকূটের এক জায়গায় লেখা আছে, “আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমারা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভাল হলো।
চিরকূটে বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি আঁচ করা যায়।
মনিরুলের ঋণের বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানও অবগত ছিলেন। পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীদ আলী মোরসেদ বলেন, মনিরুল আগে থেকেই ঋণগ্রস্ত। তিন বছর আগে মনিরুলের ঋণ নিয়ে পারিবারিকভাবে বসেও ছিলেন তারা। তখন মনিরুলের বাবা জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ শোধ করেছিলেন। কিন্তু মনিরুল আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
চেয়ারম্যান আরও বলেন, দুই দিন আগে মনিরুল তার কাছে গিয়েছিলেন। মনিরুল বলছিলেন যে, তার ঘরে চাল নেই। তখন তিনি দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন চাল কেনার জন্য।
ঋণের কথা বলছিলেন মনিরুলের এক চাচীও। তিনি বলছিলেন, মনিরুল মানুষ খারাপ ছিল না, কিন্তু ঋণগ্রস্ত ছিলেন। অনেক এনজিও থেকে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। কিস্তির জন্য তারা আসত। মনিরুল সেই চাপে বাড়িতে থাকতেন না। তখন পরিবারের লোকজন এনজিও লোকজনকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিদায় করতেন। অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, চিরকূটের লেখা প্রাথমিকভাবে মনিরুলের হাতের বলেই স্বজনরা জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তারপরও গোটা বিষয়টি পুলিশ খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে।
আরও তদন্তের পর আমরা প্রকৃত কারণটা জানতে পারব। পুলিশ বলছে, লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হবে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
