
বিদেশি ব্যাংকের আস্থা ফিরেছে এলসি পরিস্থিতি স্বাভাবিক-গভর্নর
- আপলোড সময় : ১১-০৮-২০২৫ ০৩:৪৬:২৯ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১১-০৮-২০২৫ ০৩:৪৬:২৯ অপরাহ্ন


বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের জন্য লাইন অব ক্রেডিট (এলসি) বন্ধ করেনি, বরং আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। কেউ কেউ আগের চেয়ে এলসি সীমাও বাড়িয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। গভর্নর বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে ২০০-এর বেশি বিদেশি ব্যাংক এলসি বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন আমরা অনুরোধ করি, এখানেই থামুন, আর বন্ধ করবেন না। যদি উন্নতি করতে না পারি, তখন ব্যবস্থা নেবেন। আমরা কখনও বকেয়া রাখিনি, রাখবোও না। ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া ধীরে ধীরে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়ার ফলে এখন সব বিদেশি ব্যাংক আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
ডলার বাজারে কঠোর নীতি: ড. আহসান জানান, গত বছরের ১৪ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এক ডলারও বিক্রি করেনি। ‘আমরা বুঝেছিলাম, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- ডলার বিক্রি করবো না। দুবাইভিত্তিক এগ্রিগেটরদেরও জানিয়ে দিয়েছি, আমাদের নির্ধারিত ১২২ টাকার রেটে বিক্রি করতে হবে, না হলে তাদের কাছ থেকে ডলার কেনা হবে না। তারা চাইলে ডলার ধরে রাখতে পারে, কিন্তু আমরা জানতাম, পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি তারা রাখতে পারবে না, বলেন তিনি।
অর্থনীতি ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে সতর্কতা: গভর্নর বলেন, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা এসেছে, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনও আসেনি। নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচনের আগে বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক হবে না। নির্বাচিত সরকার এসে কী পরিবর্তন আনে, তা বিনিয়োগকারীরা লক্ষ্য করবে। তিনি জানান, বাজারে তরল অর্থের প্রবাহ বাড়ছে এবং শেয়ারবাজার আগামী এক বছরে আরও এক হাজার পয়েন্ট বাড়তে পারে। এ বছর বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্ত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব সংস্কার: ড. আহসান বলেন, মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে আরও কমানো দরকার। প্রতি মাসে কমবে না, তবে অর্থবছরের শেষে তা পাঁচ শতাংশের নিচে নামতে পারে। পাশাপাশি তিনি রাজস্ব আহরণ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার: গভর্নর জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধন করে পরিচালকদের মেয়াদ ৬ বছরে সীমাবদ্ধ করা হবে এবং বোর্ডে অন্তত ৬ জন স্বাধীন পরিচালক থাকতে হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এ মৌলিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন ডিপোজিট ইন্সুরেন্স আইন প্রণয়ন এবং ব্যাংক রেগুলেশন অধ্যাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও ক্ষমতাবান করার উদ্যোগ চলছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো এক করা হবে। যেকোনো ব্যাংক নন-পারফর্মিং হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, অদক্ষ ব্যাংককে জায়গা দেওয়া হবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আইনের প্রয়োগে স্বাধীন ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, এবং আর্থিক খাতকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
গত বছরের ১৪ আগস্টের পর থেকে এক ডলারও বিক্রি হয়নি: গভর্নর: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, গত বছরের ১৪ আগস্টের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক ডলারও বিক্রি করেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার কৌশলের অংশ হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গভর্নর বলেন, আমরা বুঝেছিলাম, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা জরুরি। তাই নীতি ছিল- একটি ডলারও বিক্রি করবো না। গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত সেই নীতি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়েছে। বিদেশি ব্যাংকের লাইন অব ক্রেডিট (এলসি) পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর সময় আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে ২০০-র বেশি বিদেশি ব্যাংক এলসি বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, এখানেই থামুন, আর বন্ধ করবেন না। যদি উন্নতি না হয়, তখন ব্যবস্থা নিন। এরপর আমরা কখনও বকেয়া রাখিনি এবং রাখবোও না। তিনি আরও জানান, তখন ২.৫ বিলিয়ন ডলার বকেয়া ছিল। ধাপে ধাপে তা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রত্যেক বিদেশি ব্যাংক আগের অবস্থায় ফিরেছে, এমনকি কেউ কেউ লাইন অব ক্রেডিটও বাড়িয়েছে। দুবাইভিত্তিক এগ্রিগেটরদের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘তাদের স্পষ্ট করে জানানো হয়েছিল- আমাদের নির্ধারিত ১২২ টাকার রেটে ডলার বিক্রি করতে হবে, নইলে তাদের কাছ থেকে ডলার কেনা হবে না। তারা চাইলে ডলার ধরে রাখতে পারে, কিন্তু আমরা জানি পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি তারা রাখতে পারবে না। গভর্নরের মতে, এসব পদক্ষেপ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হয়েছে।
টাকা ছাপানোতে বছরে ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা: বাংলাদেশে নগদ টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বণ্টনে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ বিপুল খরচ কমাতে ক্যাশলেস বা নগদবিহীন লেনদেন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গভর্নর জানান, কাগুজে নোটের ব্যবহার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেন জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য নীতিগত সহায়তা ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। ‘লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কিউআর কোড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে’, বলেন আহসান এইচ মনসুর। এতে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা- সবার লেনদেন হবে দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ; পাশাপাশি রাষ্ট্রের খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে বলে জানান তিনি। ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য স্মার্টফোনের গুরুত্ব তুলে ধরে গভর্নর বলেন, ‘বর্তমানে আর্থিক লেনদেন, বিল পরিশোধ বা যেকোনো অনলাইন সেবা নিতে স্মার্টফোন অপরিহার্য।’ তিনি জানান, ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের স্মার্টফোন বাজারে আনতে কাজ চলছে, যাতে শতভাগ মানুষ এ সুবিধার আওতায় আসে। এ লক্ষ্য পূরণে ইন্টারনেটের দাম কমানো ও সেবার মান উন্নত করার প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। নগরায়ণ ও আবাসন খাত প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘দেশে এখনও কয়েক মিলিয়ন নতুন আবাসনের প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ আর গ্রামে ফিরবে না- এটা বাস্তবতা। তাই সাশ্রয়ী আবাসন পরিকল্পনা নিতে হবে। ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা জমি ডেভেলপারদের সঙ্গে অংশীদারত্বে ব্যবহারের বিষয়েও ভাবা হচ্ছে।’ সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে সংস্কারসহ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা রফতানি খাতকে ভালো অবস্থায় রেখেছে এবং বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করেছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, রাজস্ব আহরণও বাড়ছে না- যা উদ্বেগজনক। আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ