অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হতেই চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। একদিকে বছরব্যাপী আন্দোলনের ঢল ঠেকাতে ব্যস্ত সরকার, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। তথ্য বলছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার চলতি এক বছরে মোকাবিলা করেছে প্রায় পৌনে দুইশ’টি আন্দোলন। কিন্তু এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের নানা বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতি ও সহিংসতার ঘটনায় জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে উঠেছে বড় প্রশ্ন।
গত বছরের আগস্টে ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন দেশ এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পর প্রশাসন, অর্থনীতি ও সমাজজুড়ে তৈরি হয় শূন্যতা। সেই মুহূর্তে অনেকেই আশার আলো দেখেছিলেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দাবি-দাওয়ার পাহাড় জমে ওঠে সরকারের টেবিলে। রিকশাচালক থেকে সরকারি কর্মকর্তা, কলেজ শিক্ষক থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে নামেন। কেউ চাকরির দাবিতে, কেউ বদলি বা পদোন্নতির দাবিতে। কেউ আবার কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য আন্দোলনে। এইসব কর্মসূচি একটার পর একটা সামাল দিতে দিতে নাকাল হতে হয় সরকারকে। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে আছি, যেখানে মানুষ নিজেদের মতপ্রকাশ করতে পারছে। আগের মতো আন্দোলন করলেই গুলি নয়। এখন জনগণ নিজের কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। তবে শুধু আন্দোলন সামাল দিয়েই থেমে নেই সমালোচনা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছে জনমনে। ঢাকায় ছিনতাই, ডাকাতি এবং সহিংস অপরাধ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে শুধুমাত্র ডাকাতির সময় খুনের ঘটনায় ৩৯৭টি মামলা হয়েছে। ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ ঘটেছে ৭০০টিরও বেশি। সরকার বলছে, আগের বছরের তুলনায় এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। তবে ভুক্তভোগীরা তা মানতে নারাজ। শফিকুল আলম বলেন, আমরা মনে করি, বর্তমানে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রয়েছে। ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে। শুধু সংখ্যার দিকে না তাকিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের সরকারের রেখে যাওয়া আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়া—এই দুই বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল করে রেখেছে। শুরুতেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বদল এবং বর্তমান উপদেষ্টার দক্ষতা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন মোটামুটি। তবে শুরুর দিকে অবস্থা ছিল খারাপ। আগের সরকারের কিছু প্রভাবশালী লোক এখনো প্রশাসনে রয়ে গেছে। তারা থেকে গেলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। তবে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, মব ভায়োলেন্সের ভয়েই আমাদের অনেক সময় চুপ থাকতে হচ্ছে। সাংবাদিকরা অনেক কিছু জানলেও প্রকাশ করছে না। আমি একজন সম্পাদক হিসেবে অনেক সময় এমন তথ্য প্রকাশে উৎসাহ দিতে পারছি না। এটা একটা আপসের পরিস্থিতি তৈরি করছে। শিক্ষক ও গবেষক আসিফ বিন আলী মনে করেন, সরকার আন্দোলন সামাল দিতে পারলেও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। তার মতে, এই ইস্যুতে আরও সক্রিয় হতে হতো।
এদিকে বড় বড় দুর্ঘটনা মোকাবিলাতেও সরকারের সমন্বয়হীনতা চোখে পড়েছে। বিশেষ করে মাইলস্টোন বিমান দুর্ঘটনার সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্বল প্রস্তুতি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। গত এক বছরে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো আলাদা আলাদা করে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের বিশ্লেষকরা নিজ নিজ মূল্যায়ন করছেন। কিছু বিষয়ে সবার মত এক—গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি ভেঙে পড়েছিল এবং সরকার তা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ‘মব জাস্টিস’ নামক ভয়াবহ অরাজকতা দেখা দেয় সারা দেশে, যা এখনো মাঝে মাঝে ঘটছে। এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। যদিও সরকার জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করায় এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি স্বস্তি প্রকাশ করেছে। তার মানে তারা মনে করছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে গেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী যদিও এ বিষয়ে এখনো স্বস্তিতে নেই। নির্বাচন ইস্যুতে ‘বড় দল’কেই কেবল গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার- এমন সমালোচনা করছে তারা। তাছাড়া গণহত্যার বিচার ও সংস্কার ইস্যুতে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও সমালোচনা করছে তারা। অর্থনীতির বিষয়ে সবার মূল্যায়ন মোটামুটি ইতিবাচক। ঋণের নামে প্রায় দেউলিয়া করে দেওয়া ব্যাংক খাতে মোটামুটি স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে সরকার- এটি সবার প্রশংসা পাচ্ছে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় এবং সরকারের কিছু ভালো পদক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও ডলারের মার্কেট স্থিতিশীল আছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক দল, ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের দাবিদাওয়া নিয়ে লাগাতার আন্দোলনের মুখে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে এসব পরিস্থিতি দক্ষভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাটও রোধ করা যায়নি। ফলে সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই এক বছরে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার হার আগের মতোই রয়ে গেছে, কিছু ক্ষেত্রে বরং বেড়েছে। একইভাবে হত্যা ও সহিংস অপরাধ নিয়ন্ত্রণেও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তো অন্তর্বর্তী সরকারই। তারপরও বিগত ১৬ বছর এরকম একটা স্বৈরশাসনের পর দেশের ভঙ্গুর অবস্থাতে তারা দায়িত্বভার গ্রহণ করে। অর্থনীতির সামষ্টিক যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো তো আছে, দূর হয়নি। আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি, প্রশাসনে অস্থিরতা আছে- এসব নিয়েই তারা এক বছর পার করছে। তিনি বলেন, জনগণের নির্বাচিত সরকার যত দ্রুত আসবে এই সমস্যা থেকে তত দ্রুত বের হওয়া যাবে। দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, বিগত ১ বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা কী তা আপনারা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। আসলে সরকারের করার কিছু ছিল না। অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা- সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার খুব একটা সফল হতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি খুবই উদ্বেগজনক। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমাদের মতে দেশে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সফলতা-ব্যর্থতা দুইটাই থাকে। সেই হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে মোটামুটিভাবে এখনও পরিচালনা করছে। মেজর কিছু ইস্যুকে তারা ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানুষের নিরাপত্তায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং আহতদের জীবনের দায়িত্ব নেওয়া; সর্বোপরি এই বিষয়গুলোতে সরকার মোটেই মানুষের কাছে সন্তোষজনক জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ আছে মানুষের মধ্যে এবং পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক। জুলাই গণহত্যার বিচারে সরকার কিছুটা এগোলেও কার্যকর কিছু দৃশ্যমান হয়নি বলে উল্লেখ করেন সাকি। এসব ব্যর্থতার মাঝেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখছেন রাজনৈতিক নেতারা। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বড় একটি সাফল্য হলো—ব্যাংক ও আর্থিক খাতে চলমান দুর্নীতির লাগাম টানা। অর্থপাচার বন্ধ করা এবং ব্যাংকিং সেক্টরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে সেটিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার মতো বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। তবে রাজনীতিবিদরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো—রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়ে ডান-বাম সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারা। অনেকগুলো সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কিছু দল আপত্তি জানালেও সরকার ইতোমধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছে এবং ‘জুলাই সনদ’ তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে এই দুটির বাস্তবায়ন ও আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও মতভেদ রয়ে গেছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

দায়িত্ব নেয়ার ১ বছর
আন্দোলন ঠেকিয়েও সমালোচিত সরকার
- আপলোড সময় : ০৯-০৮-২০২৫ ০২:৫৮:৩৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৯-০৮-২০২৫ ০২:৫৮:৩৩ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ